ফরয নামায সম্মিলিত দুআ-মুনাজাত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত ?

By | June 1, 2021

প্রশ্ন:

ফরয নামায বাদ সম্মিলিত দুয়া মুনাজাত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত ? বিস্তারিত জানতে চাই ৷

উত্তর: وبالله سبحانه التوفيق

নিম্নে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হল,

সম্মিলিত দুআ

حَدَّثَنَا الْحَكَمُ بْنُ نَافِعٍ أَبُو الْيَمَانِ، قَالَ: حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَيَّاشٍ عَنْ رَاشِدِ بْنِ دَاوُدَ، عَنْ يَعْلَى بْنِ شَدَّادٍ قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي شَدَّادُ بْنُ أَوْسٍ وَعُبَادَةُ بْنُ الصَّامِتِ،حَاضِرٌ يُصَدِّقُهُ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: هَلْ فِيكُمْ غَرِيبٌ؟ يَعْنِي أَهْلَ الْكِتَابِ فَقُلْنَا لَا يَا رَسُولَ اللهِ فَأَمَرَ بِغَلْقِ الْبَابِ وَقَالَ ارْفَعُوا أَيْدِيَكُمْ وَقُولُوا لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ فَرَفَعْنَا أَيْدِيَنَا سَاعَةً ثُمَّ وَضَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَهُ، ثُمَّ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ، اللهُمَّ بَعَثْتَنِي بِهَذِهِ الْكَلِمَةِ وَأَمَرْتَنِي بِهَا وَوَعَدْتَنِي عَلَيْهَا الْجَنَّةَ وَإِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ ثُمَّ قَالَ: أَبْشِرُوا، فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ غَفَرَ لَكُمْ

হযরত ইয়ালা বিন রাশেদ বলেন, হযরত আবু শাদ্দাদ আমাকে হাদীস শুনিয়েছেন আর হযরত উবাদা বিন ছামেত রা. তা সত্যায়ন করেছেন, হযরত আবু শাদ্দাদ বলেন, আমরা নবী করিম স.-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কোন গরীব তথা আহলে কিতাব আছে? আমরা বললাম, না। হে আল্লাহর রসূল, আমাদের মধ্যে আহলে কিতাবের কেউ নেই। তিনি আমাদেরকে দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা হাত উঠাও এবং لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ বল। আমরা কিছুক্ষণ হাত উঠিয়ে রাখলাম। অতঃপর রসূল হাত নামালেন এবং বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি আমাকে এ কালিমা দিয়ে পাঠিয়েছ এবং তাতে জান্নাত দানের অঙ্গীকার করেছ। আর তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ কর না। অতঃপর রসূলুল্লাহ স. বললেন: তোমরা সুসংবাদ শোন; আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ-১৭১২১)।

হাদীসটির স্তর : হাসান। আল্লামা হাইসামী বলেন, رَوَاهُ أَحْمَدُ، وَفِيهِ رَاشِدُ بْنُ دَاوُدَ، وَقَدْ وَثَّقَهُ غَيْرُ وَاحِدٍ، وَفِيهِ ضَعْفٌ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ ثِقَاتٌ. হাদীসটি ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন। আর এ হাদীসের সনদে রাশেদ বিন দাউদ নামে একজন রাবী আছেন অনেকে তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন তবে তাঁর মধ্যে কিছু দুর্বলতা আছে। অবশিষ্ট রাবীগণ সকলেই বিশ্বস্ত। (মাযমাউজ যাওয়ায়েদ-১৬৭৯৮) এ হাদীসটি তবারানী, মুসনাদে বায্যার, মুসতাদরাকে হাকেমসহ আরও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূল স. নিজে হাত উঠিয়ে সম্মিলিত দুআ করেছেন। সুতরাং এটা দুআর একটি আদব। তবে নির্জনে একাকি দুআও উত্তম।

قَالَ أَيُّوبُ بْنُ سُلَيْمَانَ حَدَّثَنِي أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي أُوَيْسٍ، عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بِلاَلٍ، قَالَ يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، قَالَ أَتَى رَجُلٌ أَعْرَابِيٌّ مِنْ أَهْلِ الْبَدْوِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلَكَتِ الْمَاشِيَةُ هَلَكَ الْعِيَالُ هَلَكَ النَّاسُ‏.‏ فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَدَيْهِ يَدْعُو، وَرَفَعَ النَّاسُ أَيْدِيَهُمْ مَعَهُ يَدْعُونَ، قَالَ فَمَا خَرَجْنَا مِنَ الْمَسْجِدِ حَتَّى مُطِرْنَا، فَمَا زِلْنَا نُمْطَرُ حَتَّى كَانَتِ الْجُمُعَةُ الأُخْرَى، فَأَتَى الرَّجُلُ إِلَى نَبِيِّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، بَشِقَ الْمُسَافِرُ، وَمُنِعَ الطَّرِيقُ‏.‏

হযরত আনাস বিন মালেক রা. বলেন: এক গ্রাম্য ব্যক্তি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ স.-এর নিকটে এসে বললো: ইয়া রসূলাল্লাহ! পশু মরে যাচ্ছে, পরিবার-পরিজন ও মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তখন রসূলুল্লাহ স. দুআর জন্য হাত তুললেন এবং লোকেরাও তাঁর সঙ্গে হাত তুলে দুআ করতে লাগলো। হযরত আনাস রা. বলেন: আমরা মসজিদ থেকে বের না হতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত বৃষ্টি হতেই থাকলো। সে ব্যক্তি পুনরায় এসে বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ! মুসাফির কষ্টে পড়ে গেছে, রাস্তা-ঘাট চলার অনুপযোগী হয়ে গেছে। (বুখারী: ৯৭৩, পৃষ্ঠা: ১/১৪০)

হাদীসটির স্তর : সহীহ। শাব্দিক কিছু তারতম্যসহ এ হাদীসটি মুসলিম, আবু দাউদ এবং নাসাঈ শরীফেও বর্ণিত হয়েছে। (জামেউল উসূল-৪২৮৯)

সারসংক্ষেপ : এ হাদীস দ্বারাও ইজতিমাঈ দুআ প্রমাণিত হয়। আর এটা ইসতিসকার নামায ছিলো না, যেখানে হাত উত্তোলন করে দুআ করা সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণিত; বরং জুমআর নামাযে খুৎবা ছিলো।

حَدَّثَنَا بِشْرُ بن مُوسَى حَدَّثَنَا أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْمُقْرِئُ حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ حَدَّثَنِي ابْنُ هُبَيْرَةَ ، عَنْ حَبِيبِ بن مَسْلَمَةَ الْفِهْرِيُّ وَكَانَ مُسْتَجَابًا أَنَّهُ أُمِّرَ عَلَى جَيْشٍ فَدَرَّبَ الدُّرُوبَ فَلَمَّا لَقِيَ الْعَدُوَّ ، قَالَ لِلنَّاسِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لا يَجْتَمِعُ مَلأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ إِلا أَجَابَهُمُ اللَّهُ ثُمَّ إِنَّهُ حَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ، فَقَالَ : اللَّهُمَّ احْقِنْ دِمَاءَنَا وَاجْعَلْ أُجُورَنَا أُجُورَ الشُّهَدَاءِ ، فَبَيْنَا هُمْ عَلَى ذَلِكَ إِذْ نَزَلَ الْهِنْبَاطُ أَمِيرُ الْعَدُوِّ، فَدَخَلَ عَلَى حَبِيبٍ سُرَادِقَهُ، قَالَ أَبُو الْقَاسِمِ الْهِنْبَاطُ بِالرُّومِيَّةِ صَاحِبُ الْجَيْشِ.

হযরত হাবীব বিন মাসলামা আল ফিহরী রা. থেকে বর্ণিত, যিনি মুসতাজাবুদ্দা’ওয়াহ ছিলেন। তাঁকে একটি মুজাহিদ বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করা হলে তিনি গিরিপথ ধরে চলতে আরম্ভ করলেন। অতঃপর যখন তিনি দুশমনের কাছে এলেন তখন বললেন, আমি রসূলুল্লাহ স.কে বলতে শুনেছি: যখন কোন দল একত্রিত হয়ে তাদের কেউ দুআ করে এবং অন্যরা আমীন বলে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করেন। এরপর তিনি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন। তারপর বললেন: হে আল্লাহ! আমাদেরকে রক্তপাত থেকে হেফাজত করুন, আমাদেরকে শহীদদের প্রতিদান দান করুন। তারা এ অবস্থায়ই ছিলেন; হঠাৎ দুশমনের নেতার আবির্ভাব ঘটলো। সে হাবীব বিন মাসলামা রা.-এর সুরঙ্গে ঢুকে পড়লো। ইমাম তবারানী বলেন: রুমী ভাষায় হাম্বাত হলো সেনা প্রধান। (তবারানী কাবীর: ৩৪৫৬, মুসতাদরাকে হাকেম: ৫৪৭৮, মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ১৭৩৪৭)

হাদীসটির স্তর : হাসান। বিশির বিন মুসা ব্যতীত এ হাদীসের রাবীগণ সকলেই বুখারী/মুসলিমের রাবী। আর বিশির বিন মুসা ثقةٌ নির্ভরযোগ্য। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, তবকা-১৫, রাবী নং-১৭০) ইমাম জাহাবী তাঁর ‘তালখীছে’ এ হাদীসের ওপর কোন আপত্তি করেননি। আল্লামা হাইসামী বলেন: رجاله رجال الصحيح غير ابن لهيعة وهو حسن الحديث ইবনে লাহীআহ ব্যতীত এ হাদীসটির রাবীগণ সহীহ হাদীসের রাবী। আর ইবনে লাহীআহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ভালো। সম্মিলিত দুআর বিষয়টি যেহেতু অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। সুতরাং এ হাদীসটি হাসান।

সারসংক্ষেপ : এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন দুআ করে আর অন্যরা আমীন বলে এমন ইজতিমাঈ দুআ আল্লাহর তাআলার নিকট কবুল হওয়ার বেশী উপযুক্ত।

নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ

حَدَّثَنَا مُحَمَّدٌ حَدَّثَنَا عُمَرُ بْنُ حَفْصٍ قَالَ حَدَّثَنَا أَبِي عَنْ عَاصِمٍ عَنْ حَفْصَةَ عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ كُنَّا نُؤْمَرُ أَنْ نَخْرُجَ يَوْمَ الْعِيدِ حَتَّى نُخْرِجَ الْبِكْرَ مِنْ خِدْرِهَا حَتَّى نُخْرِجَ الْحُيَّضَ فَيَكُنَّ خَلْفَ النَّاسِ فَيُكَبِّرْنَ بِتَكْبِيرِهِمْ وَيَدْعُونَ بِدُعَائِهِمْ يَرْجُونَ بَرَكَةَ ذَلِكَ الْيَوْم وَطُهْرَتَهُ

হযরত উম্মে আতিয়াহ রা. বলেন: ঈদের দিনে আমাদেরকে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হতো। এমনকি কুমারীদেরকে তাদের অন্দর মহল থেকে বের করতাম এবং ঋতুবতী নারীদেরকেও। তারা পুরুষদের পিছনে থাকত আর তাদের তাকবীরের সাথে তাকবীর বলত এবং দুআর সাথে দুআ করত। তারা সে দিনের বরকত ও পবিত্রতা আশা করতো। (বুখারী: ৯২০)

হাদীসটির স্তর : সহীহ। শাব্দিক কিছু তারতম্যসহ এ হাদীসটি সেহা সেত্তার সব কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (জামেউল উসূল-৪২৬৩)

সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ প্রমাণিত হয়। এ হাদীসে ঋতুবতী মহিলাদেরকে ঈদগাহে গিয়ে মুসলমানদের দুআয় শরীক হতে বলা হয়েছে; যা নামাযের পরে হয়ে থাকে। কেননা ঈদের ময়দানে প্রথম যে কাজটি করা হয় তাহলো নামায পড়া (বুখারী: ৫১৬২)। আর খুতবা ও দুআ হয় নামাযের পরে। ‘মুসলমানদের সাথে দুআয় শরীক হওয়া’ শব্দ থেকে সম্মিলিত দুআর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। এ ছাড়াও বুখারী ৯২৮ নম্বর হাদীসে বর্ণিত আছে যে, فَلْيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ وَدَعْوَةَ الْمُؤْمِنِين তারা যেন কল্যাণকর কাজ এবং মুমিনদের দুআয় শরীক হয়। এ থেকেও নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।

ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ

فَنَادَى مُنَادِي الْعَلَاءِ فَاجْتَمَعَ النَّاس إِلَيْهِ، فَقَالَ: أيُّها النَّاس أَلَسْتُمُ الْمُسْلِمِينَ؟ أَلَسْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ أَلَسْتُمْ أَنْصَارَ اللَّهِ؟ قَالُوا: بَلَى، قَالَ: فَأَبْشِرُوا فَوَاللَّهِ لَا يَخْذِلُ اللَّهُ مَنْ كَانَ فِي مِثْلِ حَالِكُمْ، وَنُودِيَ بِصَلَاةِ الصُّبح حِينَ طَلَعَ الْفَجْرُ فصلَّى بالنَّاس، فلمَّا قَضَى الصَّلاة جَثَا عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَجَثَا النَّاس، وَنَصِبَ فِي الدُّعاء وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَفَعَلَ النَّاس مِثْلَهُ حَتَّى طَلَعَتِ الشَّمْسُ،

অনুবাদ : হযরত আলা বিন হাযরামী রা.-এর ঘোষক ঘোষণা দিলেন। অতঃপর লোকেরা একত্রিত হলে তিনি বললেন: হে লোক সকল! তোমরা কি মুসলমান নও? তোমরা কি আল্লাহর রাস্তায় নও? তোমরা কি আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী নও? তারা বললেন: হ্যাঁ। হযরত আলা বলেন: তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহর শপথ! তোমাদের মতো অবস্থা যার হবে আল্লাহ তাদেরকে অপদস্ত করবেন না। অতঃপর সুবহে সাদিকের সময় হলে ফজরের আজান দেয়া হলো। অতঃপর তিনি নামায পড়ালেন এবং নামায শেষ করে হাঁটু গেড়ে (তাশাহহুদের বৈঠকের ন্যায়) বসলেন; লোকেরাও হাঁটু গেড়ে বসলেন। হযরত আলা বিন হাযরামী রা. নিজে সুর্যোদয় পর্যন্ত হাত উত্তোলন করে দুআয় মশগুল থাকলেন এবং লোকেরাও অনুরূপ করলো। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ: বাহরাইনের মুরতাদদের আলোচনায়) আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বর্ণিত এ ঘটনাটি সনদসহ প্রায় হুবহু বর্ণনা করেছেন আল্লামা ইবনে জারীর তবারী রহ. তাঁর ‘তারীখে তাবারী’ কিতাবে। তাঁর বর্ণনা নিন্মরুপ,

كَتَبَ إِلَيَّ السَّرِيُّ، عَنْ شُعَيْبٍ، عَنْ سيف، عن الصعب بن عطية ابن بِلالٍ، عَنْ سَهْمِ بْنِ مِنْجَابٍ، عَنْ مِنْجَابِ بْنِ رَاشِدٍ، قَالَ: بَعَثَ أَبُو بَكْرٍ الْعَلاءَ بْنَ الْحَضْرَمِيِّ عَلَى قِتَالِ أَهْلِ الرِّدَّةِ بِالْبَحْرَيْنِ،.. وَنَادَى الْمُنَادِي بِصَلاةِ الصُّبْحِ حِينَ طَلَعَ الْفَجْرُ فَصَلَّى بِنَا، وَمِنَّا الْمُتَيَمِّمُ، وَمِنَّا مَنْ لَمْ يَزَلْ عَلَى طُهُورِهِ، فَلَمَّا قَضَى صَلاتَهُ جَثَا لِرُكْبَتَيْهِ وَجَثَا النَّاسُ، فَنَصَبَ فِي الدُّعَاءِ وَنَصَبُوا مَعَهُ،

অনুবাদ : ফজরের নামাযের ওয়াক্ত হলে মুআজ্জিন আজান দিলেন। অতঃপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন। আমাদের মধ্যে কেউ ছিল তায়াম্মুমকারী আর কেউ ছিলো আগে থেকে পবিত্র। নামায শেষ করে তিনি হাঁটু গেড়ে (তাশাহহুদের বৈঠকের ন্যায়) বসলেন এবং লোকেরা সবাই হাঁটু গেড়ে বসলো। হযরত আলা বিন হাযরামী রা. দুআয় মশগুল হলেন এবং লোকেরাও দুআয় মশগুল হলো। (তারীখে তাবারী, অধ্যায়: বাহরাইনবাসী এবং তাদের মুরতাদ হওয়ার আলোচনা)

ফায়দা : তারীখে তাবারীতে উল্লিখিত সনদটি গ্রহণযোগ্য। কারণ, হযরত আলা বিন হাযরমী রা. বর্ণিত বাহরাইনের মুরতাদদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এ ইতিহাস উম্মাতের নিকটে প্রসিদ্ধ। আবার ইলমে হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন তিন তিনজন মহা মনীষী হযরত আলা বিন হাযরমী রা.-এর উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। উপরন্তু, হাদীস আর ইতিহাস দুটি আলাদা বিষয়। অতএব, হাদীসের সনদ গ্রহণের শর্তাবলী ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তার প্রমাণ হিসেবে এ ঘটনার বর্ণনাকারী সাইফের প্রতি লক্ষ্য করুন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাঁর ব্যাপারে বলেন: ضعيف فى الحديث عمدة فى التاريخ “তিনি হাদীসের ব্যাপারে দুর্বল; তবে ইতিহাসের ব্যাপারে عمدة বিশ্বস্ত। (তাকরীব: ৩০১৫)। সুতরাং ইতিহাস হিসেবে এ ঘটনাটি গ্রহণযোগ্য।

فَقَالَ: لَنْ تُرَاعُوا، أَنْتُمُ الْمُسْلِمُونَ، وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَأَنْصَارُ اللَّهِ فَأَبْشِرُوا فَوَاللَّهِ لَنْ تُخْذَلُوا فَلَمَّا صَلَّوُا الصُّبْحَ دَعَا الْعَلَاءُ وَدَعَوْا مَعَهُ،

অনুবাদ : হযরত আলা বিন হাযরমী রা. বলেন: তোমরা ভয় পেও না। তোমরা মুসলমান, আল্লাহর রাস্তায় রয়েছো এবং তোমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী। তোমরা সুসংবাদ শোন। আল্লাহর শপথ, তোমরা কখনই অপদস্ত হবে না। যখন ফজরের নামায পড়লেন, হযরত আলা দুআ করলেন এবং তাঁর সাথীরাও তাঁর সাথে দুআ করলেন। (আল কামিল ফিত্ তারীখ, লিইবনে আসীর যাঝারী)

সারসংক্ষেপ : হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী ইবাদাতের ক্ষেত্রে সাহাবাদের আমল হুকমী মারফু’ অর্থাৎ রসূলুল্লাহ স. থেকে শুনে বা দেখে করেছেন বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে। সুতরাং হযরত আলা বিন হাযরামী রা. ও তাঁর সাথীদের আমল থেকে ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআ শরীআত সম্মত বলে প্রমাণিত হয়।

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَيَّاشٍ حَدَّثَنِي حَبِيبُ بْنُ صَالِحٍ عَنْ يَزِيدَ بْنِ شُرَيْحٍ، عَنْ أَبِي حَىٍّ الْمُؤَذِّنِ الْحِمْصِيِّ عَنْ ثَوْبَانَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏لاَ يَحِلُّ لاِمْرِئٍ أَنْ يَنْظُرَ فِي جَوْفِ بَيْتِ امْرِئٍ حَتَّى يَسْتَأْذِنَ فَإِنْ نَظَرَ فَقَدْ دَخَلَ وَلاَ يَؤُمَّ قَوْمًا فَيَخُصَّ نَفْسَهُ بِدَعْوَةٍ دُونَهُمْ فَإِنْ فَعَلَ فَقَدْ خَانَهُمْ وَلاَ يَقُومُ إِلَى الصَّلاَةِ وَهُوَ حَقِنٌ قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي أُمَامَةَ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ ثَوْبَانَ حَدِيثٌ حَسَنٌ

হযরত ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: অনুমতি ব্যতীত কারও ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করা জায়েয নেই। কেউ যদি কারও ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করে, তবে তো সে তাতে প্রবেশই করে ফেললো। কোন জনসমষ্টির ইমামতি করে দুআর বেলায় তাদের বাদ দিয়ে কেবল নিজের জন্য দুআ করবে না। এরূপ করলে তাদের সাথে খেয়ানত করা হবে। পেশাব-পায়খানার বেগরুদ্ধ করে কেউ নামাযে দাঁড়াবে না। ইমাম তিরমিজী রহ. বলেন: সাওবান রা.-এর হাদীসটি হাসান এবং এ বিষয়ে হযরত আবু হুরায়রা ও আবু উমামা রা. থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। (তিরমিজী: ৩৫৭, পৃষ্ঠা: ১/৮২)

হাদীসটির স্তর : হাসান। ইমাম তিরমিজী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আর ইমাম বুখারী বলেন, أَصَحُّ مَا يُرْوَى فِي هَذَا الْبَابِ هَذَا الْحَدِيثُ. এটা এ অধ্যায়ের সবচেয়ে সহীহ হাদীস। (আল আদাবুল মুফরাদ-১০৯৩) শাব্দিক কিছু তারতম্যসহ এ হাদীসটি ইবনে মাজা এবং আবু দাউদ শরীফেও বর্ণিত হয়েছে। (জামেউল উসূল-৩৮৪৭)

সারসংক্ষেপ : এ হাদীসে মুক্তাদীদেরকে বাদ দিয়ে ইমাম শুধু তাঁর নিজের জন্য দুআ করলে এটাকে রসূলুল্লাহ স. মুক্তাদীদের সাথে খেয়ানত বলে উল্লেখ করেছেন। নামাযের মধ্যে আমরা যে দুআ পড়ে থাকি তার কোনটায় মুক্তাদীদেরকে শরীক করে কোন দুআ নেই। দুই সিজদার মাঝে এবং দুরুদের পরে যে দুআ হাদীসে বর্ণিত আছে তাও কেবল নিজের জন্য। তাহলে এ কথা বলা যেতে পারে যে, খেয়ানত থেকে বাঁচার কোন ব্যবস্থা নামাযে পঠিত দুআগুলোতে নেই। অবশ্য, নামাযের পরের দুআকে হিসেব করলে উক্ত খেয়ানত থেকে বাঁচার একটি পথ পাওয়া যেতে পারে। নামাযের পরে দুআর আমল পূর্ববণিত বেশ কিছু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া হাদীসের ভাষার প্রতি লক্ষ্য করলেও নামাযের পরের দুআই বুঝে আসে। কারণ ইমামতি করা আর দুআ করা এ দুইয়ের মাঝে ف অক্ষরটি ব্যবহার করা হয়েছে যা ধারাবাহিকতার অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ আগে ইমামতির কাজ শেষ করবে তারপর দুআ করবে। আর ইমামতির কাজ শেষ হয় সালামের মাধ্যমে। সুতরাং দুআ হবে সালামের পরে। এখন فَيَخُصَّ نَفْسَهُ بِدَعْوَةٍ دُونَهُمْ -এর অর্থের ব্যাপারে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে। এক. শুধু নিজের জন্য দুআ করা, অন্যদের জন্য না করা; দুই. অন্যদেরকে সাথে না নিয়ে একা একা দুআ করা। দ্বিতীয় অর্থটি হয়তো নতুন মনে হচ্ছে। তবে উলামায়ে কিরামের খেদমতে আরয, আরবী ইবারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, এ অর্থটিও হতে পারে কিনা। যদি ইবারতে এ অর্থের সম্ভাবনা না থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আর যদি সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এটাও ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআর একটি দলীল হতে পারে।

উপরোল্লিখিত হাদীসগুলো দ্বারা নামাযের পরে দুআ, দুআর সময় হাত উত্তোলন করা, ইজতিমাঈ দুআ, একজন দুআ করা আর অন্যদের আমীন বলা, ঈদের নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ, এমনকি সাহাবার আমল দ্বারা ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআও প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআকে ভিত্তিহীন বলার কোন সুযোগ নেই। অবশ্য, রসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কিরাম এ আমলটি স্থায়ীভাবে করেছেন মর্মে কোন পরিষ্কার বর্ণনা হাদীসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হাদীসের মর্মানুসারে ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআ মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দেয়া উত্তম। যাতে সাধারণ মানুয়ের মধ্যেও এ বুঝ সৃষ্টি হয় যে, এটা মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল; সুতরাং করা উত্তম হলেও না করাতে কোন দোষ নেই।

কোন কোন আলিম ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআর আমলকে ভিত্তিহীন এবং বিদআত বলে থাকেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। পূর্ববর্ণিত মারফু’ হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের আমলের সমষ্টি দ্বারা প্রায় স্পষ্টভাবেই এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

উপরুন্তু কোন আমলের পরিপূর্ণ রূপ নির্দিষ্ট একটা হাদীস বা একটা আয়াতে থাকতে হবে এমন দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতসহ প্রায় সব ইবাদাতের পূর্ণাঙ্গ রূপ কোন একটি হাদীসে আসেনি।

সুতরাং ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআর আমল একই হাদীসে বর্ণিত থাকতে হবে তা সঠিক নয় এবং কোন আমল গ্রহণযোগ্য হওয়া বা না হওয়ার শর্তও নয়।

আবার কোন আমল ছুন্নাত বা মুস্তাহাব প্রমাণিত হওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ স. এবং সাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক বার বার করতে হবে তা-ও জরুরী নয়।

যেমন ইসতিসকার নামায সুন্নাত; অথচ রসূলুল্লাহ স. সারা জীবনে মাত্র একবার পড়েছেন।

পরবর্তীতে বৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে জুমআর খুতবায় সম্মিলিত দুআ করেছেন; কিন্তু ইসতিসকার নামায পড়েননি। (বুখারী: ৯৭৩)

নামাযের পরে দুআ করা একটি নফল কাজ। এটা মাঝে মধ্যে করা যেতে পারে। আবার স্থায়ীভাবেও করা যেতে পারে।

হযরত আয়েশা রা. চাশতের আট রাকাত নামায পড়তেন। অতঃপর বলতেন: لَوْ نُشِرَ لِي أَبَوَايَ مَا تَرَكْتُهُنَّ আমার পিতা-মাতাকে জীবিত করে দেয়া হলেও আমি এটা ছাড়বো না। (মুওয়াত্তা মালেক: ৩৬২)

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নফল ইবাদত গুরুত্ব সহকারে স্থায়ীভাবে আদায় করলে সেটা বিদআত হয়ে যাবে তা নয়।

একাকি নির্জনে দুআ উত্তম হলেও প্রকাশ্যে সম্মিলিত দুআ রসূলুল্লাহ স. নিজে করেছেন।

অতএব, ফরয নামাযের পরের দুআও একত্রে করা যেতে পারে। হযরত আলা বিন হাজরমী রা.-এর আমল দ্বারা এ বিষয়টির বাস্তব উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়।

হাদীসের ইশারা-ইঙ্গীত দ্বারা এটা যতটা পরিস্কার হয়েছে নফল বা মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু প্রয়োজন হয় না। উপরুন্তু ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর আমল উম্মতের মধ্যে ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে।

সুতরাং সুন্নাত আদায়ে দেরি না হয় এবং মাসবুকদের নামায আদায়ে সমস্যা না হয় এমনভাবে ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর আমল করা উত্তম হবে।

মোট কথা, এটা সর্বজন বিদিত যে, দুআ একটি নফল ইবাদাত। এর জন্য কোন সুনির্ধারিত সময় নেই। তবে দুআ কবুল হওয়ার কিছু খাছ সময়ের কথা হাদীসে বর্ণিত আছে।

আর কিছু খাছ আদবের কথাও বর্ণিত আছে যা দুআ কবুলের জন্য সহায়ক।

সেসব খাছ সময়ের মধ্যে একটি হলো ফরয নামাযের পর। (তিরমিজী: ৩৪৯৯)

আর আদবসমূহের মধ্যে রয়েছে হাত উত্তোলন করা। (আবু দাউদ: ১৪৮৬)

ইজতিমাঈ দুআ যদিও দুআর কোন আদব নয়; তবে একত্রে অনেক মানুষের দুআ রসূলুল্লাহ স.-এর আমল দ্বারা প্রমণিত (বুখারী: ৯৭৩)

এবং আল্লাহ তাআলার নিকটে অধিক পছন্দনীয়। (মুসতাদরাকে হাকেম: ১৮৩১)

আর বুখারী শরীফের ৯২০ নম্বর হাদীসও এর প্রতি ইঙ্গিত করে। নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে সম্মিলিত দুআ করা উপরোক্ত নিয়মের বাইরে নয়।

উপরুন্তু, হযরত আলা বিন হাযরমী রা.-এর আমল (তারীখে তাবারী, আল কামিল ফিত তারীখ ও আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ: ৬/৩৬১) দ্বারা এর গ্রহণযোগ্যতা পূর্ণতায় পৌঁছেছে।

এসব কিছুর পরও এটাকে বিদআত বলার কারণ কী তা আমার বোধগম্য নয়। বিদআত তো এমন বিষয়কে বলা হয় যার কোন ভিত্তি خير القرون-এ পাওয়া যায় না। অথচ আলা বিন হাযরামী রা.-আরে আমলসহ পূর্ববর্ণিত হাদীসগুলো দ্বারা তার মজবুত ভিত্তি প্রমাণিত হয়েছে।

বর্তমান দেখা যায়, ফজর ও আসরের নামাযের পরে প্রায় অর্ধেক মুসল্লী মুনাজাতের পূর্বেই উঠে যায়। ইজতিমাঈ দুআকে বিদআত বলার পরিণামে একাকী দুআর সুুন্নাতও ইতিমধ্যে বিদায় নিতে চলেছে। তারপরেও মুনাজাতকে ‘জনসাধারণ জরুরী মনে করে তাই ছেড়ে দেয়া উচিত’ বলে আমরা নতুন করে আর কোন প্রমাণের অপেক্ষায় আছি?

কুরআন-হাদীসের মূলনীতির আলোকে যেটা জায়েয হয় এবং সাহাবার আমল দ্বারা সমর্থিত হয় সেটাকে স্পষ্ট কোন দলীল ব্যতীত বিদআ’ত বলে প্রত্যাখ্যান করায় দ্বীনের স্বার্থ রক্ষা হবে কি?

উপরোক্ত বিষযটিকে আরও একটু স্পষ্ট করতে এ ব্যাপারে প্রখ্যাত কয়েকজন উলামায়ে কিরামের মন্তব্য পাঠকদের খেদমতে পেশ করছি

দুআর ব্যাপারে কিছু বিশিষ্ট উলামায়ে কিরামের মন্তব্য :

ইমাম নাওয়াভী রহ বলেন;

.الدعاء للإمام و المأموم والمنفرد مستحب عقب كل الصلوات بلا خلاف ويستحب ان يقبل على الناس

ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী নামাযী সকলের জন্য প্রত্যেক নামাযের পরে দুআ করা সর্বসম্মতিক্রমে মুস্তাহাব। আর ইমামের জন্য মুস্তাহাব হলো (দুআর সময়) মুসল্লিদের দিকে ফেরা। (শরহুল মুহাজ্জাব: ৩য় খন্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠা)

হযরত মাওলানা মুফতী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.;

ফকীহুন্নফস হযরত মাওলানা মুফতী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.ও মুনাজাত অস্বীকারকারীদের সমালোচনা করেছেন। (আল কাওকাবুদ্দুররী: ২/২৯১)

হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.

নামাযের পরে ইমামের দুআ করা এবং উপস্থিত লোকদের আমীন বলার বিষয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। ইমাম ইবনে আরাফা এবং অন্যান্যদের বক্তব্যের সার কথা এই যে, যদি নামাযের পরের দুআ এই বিশ্বাসে করা হয় যে, এটা নামাযের ছুন্নাত-মুস্তাহাবসমূহের একটি সুন্নাত বা মুস্তাহাব আমল। তাহলে এটা বৈধ নয়। তবে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করা ব্যতীত যদি এ জন্য দুআ করে যে, এটা স্বতন্ত্র একটা মুস্তাহাব ইবাদাত। তাহলে দুআর মূল হুকুমের উপর ভিত্তি করে এটাও মুস্তাহাব হবে যেহেতু দুআর ফজিলত কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (ইমদাদুল ফতোয়া-১ম খন্ড, ৮০৪ পৃষ্ঠা)

মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রহ.

মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রহ. বলেন: ফরয নামাযের পরে ইমাম সাহেব কর্তৃক উচ্চ আওয়াজে দুআ করা এবং মুক্তাদী কর্তৃক আমীন আমীন বলার পদ্ধতিকে জরুরী মনে না করলে বৈধ। (কিফায়াতুল মুফতী: ৩য় খন্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা)

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.

واعلم أن الأدعية بهذه الهيئة الكذائية لم تَثْبُت عن النبيِّ صلى الله عليه وسلّم ولم يَثْبُت عنه رفع الأيدي دُبُر الصلوات في الدعوات إلا أقل قليل، ومع ذلك وَرَدَت فيه ترغيباتٌ قوليةٌ، والأمر في مثله أن لا يُحْكَم عليه بالبدعة، فهذه الأدعية في زماننا ليست بسنةٍ بمعنى ثبوتها عن النبيِّ صلى الله عليه وسلّم وليست ببدعة بمعنى عدم أصلها في الدين،….

আজানের পরে হাত উঠিয়ে দুআ করার বিষয়ে হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. বলেন: জেনে রাখ যে, অনুরূপ পদ্ধতিতে দুআ করা রসূলুল্লাহ স. থেকে প্রমাণিত নয়। আর নামাযের পরে হাত তুলে দুআ করার আমলও রসূলুল্লাহ স. থেকে খুব কমই পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে মৌখিক উৎসাহ প্রমাণিত। এ জাতীয় বিষয়কে বিদআত বলা যায় না। আমাদের যুগের এ দুআ রসূলুল্লাহ স. থেকে প্রমাণিত সুন্নাত নয়। আবার দ্বীনের মধ্যে ভিত্তিহীন বিদআতও নয়।

আরও কিছু পরে গিয়ে তিনি বলেন:

فإن ذُقْتَ هذا، نفِّس عن كُرَبٍ ضَاقَ بِهَا الصدر، لا أن الرفعَ بدعةٌ، فقد هَدِىَ إليه في قوليات كثيرة، وفعله بعد الصلاة قليلا، وهكذا شأنه في باب الأذكار والأوراد، اختار لنفسه ما اختاره الله له. وبقي أشياء رَغَّب فيها للأمة، فإن التزم أحد منا الدعاء بعد الصلاة برفع اليد، فقد عَمِلَ بما رغَّب فيه، وإن لم يكثره بنفسه. فاعلم ذلك اه.

যদি এ বিষয়গুলো তুমি অনুধাবন করে থাক তাহলে তোমার মনের সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দাও। (দুআর সময়) হাত তোলা বিদআত নয়। রসূলুল্লাহ-এর অনেক কথা এবং নামাযের পরে কিছু কাজ সেদিকে পথ দেখিয়েছে। আর এমনই অবস্থা জিকির ও অজীফার। রসূলুল্লাহ স. নিজের জন্য তাই বেছে নিয়েছেন আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য যা পছন্দ করেছেন। আর কিছু বিষয় তিনি উম্মাতকে উৎসাহিত করেছেন। আমাদের কেউ যদি নামাযের পরে হাত উঠিয়ে দুআ করার আমল করতে থাকে তাহলে সে এমন আমল করলো যে কাজে রসূলুল্লাহ স. উৎসাহ দিয়েছেন; যদিও তিনি নিজে এ কাজ বেশী করেননি। (ফাইজুল বারী: ‘মুয়াজ্জিনের আজান শুনে কী বলবে’ অধ্যায়)

আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ.

فهذه وما شاكلها تكاد تكفى حجة لما اعتاده الناس فى البلاد من الدعات الإجتماعية دبر الصلوات ولذا ذكره فقهاؤنا أيضا كما فى نور الإيضاح و شرحه مراقى الفلاح للشرنبلالى ويقول النووى فى شرح المهذب الدعاء للإمام و المأموم والمنفرد مستحب عقب كل الصلوات بلا خلاف ويستحب ان يقبل على الناس قلت وثبت الدعاء مستقبل القبلة أيضا كما تقدم فى حديث ابى هريرة عند ابى حاتم فثبتت الصورتان جميعا فلينبه-(معارف السنن,۳/۱۲۳ باب ما يقول إذا سلم)

হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. বেশ কিছু হাদীস পেশ করার পরে বলেন:

এগুলো এবং এর অনুরূপ যা আছে তা দ্বারা আমাদের দেশে প্রচলিত নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর প্রমাণের জন্য প্রায় যথেষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর কথা আমাদের ফকীহগণ বলেছেন। যেমনটি উল্লেখ রয়েছে আবুল হাসান শারান্বুলালীর লিখিত ‘নুরুল ঈযাহ’ এবং উক্ত কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মারাকিল ফালাহ’ কিতাবে। ইমাম নববী ‘শরহুল মুহাজ্জাব’ কিতাবের ৩য় খন্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠায় বলেন: ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী নামাযী সকলের জন্য প্রত্যেক নামাযের পরে দুআ করা সর্বসম্মতিক্রমে মুস্তাহাব। আর ইমামের জন্য মুস্তাহাব হলো (দুআর সময়) মুসল্লীদের দিকে ফেরা। আল্লামা বিন্নুরী রহ. বলেন: কিবলার দিকে ফিরে দুআ করাও প্রমাণিত, যেভাবে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে তাফসীরে আবু হাতিমে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং (মুসল্লীদের দিকে ফিরে এবং কিবলামুখী হয়ে) উভয় পদ্ধতিই প্রমাণিত হলো। সুতরাং বিষয়টি ভেবে দেখুন। (মাআরিফুস সুনান: ৩/১২৩, ‘সালামের পরে কী বলবে’ অধ্যায়)

আল্লামা জাফর আহমাদ উসমানী রহ. 

ان ما جرى به العرف فى ديارنا ان الإمام يدعو فى دبر بعض الصلوات مستقبلا للقبلة ليس ببدعة بل له أصل من السنة وإن كان الأولى أن ينحرف الإمام بعد كل صلاة يمينا أويسارا (إعلاء السنن(

প্রখ্যাত হাদীস সংকলক হযরত মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী রহ. বলেন: “আমাদের দেশে যে রীতি প্রচলিত রয়েছে যে, ইমাম সাহেব কোন কোন নামযের পরে কিবলামুখী হয়ে দুআ করেন, তা বিদআত নয়। বরং হাদীসে উক্ত দুআর ভিত্তি রয়েছে। যদিও ইমামের জন্য প্রত্যেক নামাযের পর ডানে বা বামে ফেরা উত্তম”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৯৯)

তিনি আরও বলেন: “আমাদের দেশে যে সম্মিলিত মুনাজাতের প্রথা চালু আছে যে, ইমাম সাহেব নামাযের পরে কিবলামুখী বসে দুআ করে থাকেন, এটা কোন বিদআত কাজ নয়। বরং হাদীসে এর প্রমাণ রয়েছে। তবে ইমামের জন্য উত্তম হলো ডানদিক বা বামদিকে ফিরে মুনাজাত করা”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৬৩, ৩/১৯৯)

তিনি আরও বলেন: “হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। যেমন আমাদের দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে প্রচলিত আছে”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৬৭, ৩/২০৪) এরপর তিনি নামাযের পরে মুনাজাত অস্বীকারকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। (ই’লাউস সুনান: ৩/২০৩)

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর নিন্মলিখিত মন্তব্যকে এ বিষয়ের সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে।

হযরত বলেন: “আমাদের যুগের এ দুআ রসূলুল্লাহ স. থেকে প্রমাণিত সুন্নাত নয়। আবার এটা দ্বীনের মধ্যে ভিত্তিহীন বিদআতও নয়।” তিনি আরও বলেন: “কেউ যদি নামাযের পরে হাত উঠিয়ে দুআ করার আমল করতে থাকে তাহলে সে এমন আমল করলো যে কাজে রসূলুল্লাহ স. উৎসাহ দিয়েছেন; যদিও তিনি নিজে এ কাজ বেশী করেননি।”

এ বিষয়টি নিয়ে এত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা কাউকে দিয়ে ফরয নামাযের পরে হাত উঠিয়ে সম্মিলিত দুআ করানো বা ছাড়ানো আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং আমার উদ্দেশ্য হলো যারা এটাকে বিদআত বলে থাকেন তারা বিদআত বলা বন্ধ করুন। 

আর যারা এটাকে আবশ্যকীয়ভাবে আঁকড়ে ধরেছেন তারা তা বর্জন করুন ৷والله تعالى اعلم

উত্তর প্রদান:

মুফতী মাসুম বিল্লাহ

Facebook Comments Box