মা-বাবার ভরণ-পোষণ কি কন্যা সন্তানকেও দায়িত্ব নিতে হবে?

By | November 2, 2021

প্রশ্ন:

পিতা-মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্ব যদি পুত্র সন্তান থাকে তাহলে সেই তার বাবা-মার দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু যদি শুধু কন্যা সন্তান থাকে এবং যদি তাকে তার স্বামী চাকরি করতে না দেয় তাহলে তার পিতা মাতার দায়িত্ব কার ওপর বর্তায়?

এক্ষেত্রে কি মেয়ে জামাই তার শশুর শাশুড়ির দায়িত্ব নেবে?

ইসলামে এ সম্পর্কে কি বলে?

উত্তর: وبالله سبحانه التوفيق

মাবাবার সঙ্গে সদাচারণযার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে এবং রাসুলুল্লাহ তাঁর বহু হাদিসে দিয়েছেন।

উক্ত নির্দেশ ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোকউভয়ের প্রতি।

কেননাসন্তানবলতেছেলেমেয়েউভয়কেই বুঝানো হয়েছে। আর মাবাবার জন্য সামর্থ্য অনুপাতে খরচ করা, তাঁদের খেদমত করা একপ্রকারসদাচারণ

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদব্যবহার কর। (সূরা ইসরা ২৩)
অন্যত্র তিনি বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ
তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও-যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে,আত্নীয়-আপন জনের জন্যে…। (সূরা বাকারা ২১৫)

হাদিছ শরিফে এসেছে,

আয়েশা রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,

إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلَ الرَّجُلُ مِنْ كَسْبِهِ ، وَوَلَدُهُ مِنْ كَسْبِهِ
নিশ্চয় মানুষের জন্য সবচে’ উত্তম রিজিক হল, নিজের উপার্জন। আর নিজ সন্তান নিজেরই উপার্জন। (আবু দাউদ ৩৫২৮)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার (কিছু) সম্পদ আছে এবং পিতা আছেন। কিন্তু পিতা আমার সব সম্পদ নিয়ে যেতে চান! তখন নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ দুটোই তোমার পিতার। তোমাদের সন্তানরা হচ্ছে তোমাদের উত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা নিজ সন্তানের উপার্জন ভোগ করো।’ সুনানে আবু দাউদ /৮০১, হাদীস : ৩৫৩০, ৩০৬৭; সুনানে ইবনে মাজাহ /৭৬৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৮২৬৬৯৬২

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়,  সন্তানের উপার্জন পিতামাতার উপার্জন বলেই গণ্য। সুতরাং নিজের উপার্জন থেকে যেমন ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ হয় তেমনি সন্তানের সম্পদ থেকেও পিতামাতার প্রয়োজন পূরণ হবে। 

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খরচের ব্যাপারে তুমি আগে নিজের প্রয়োজনীয় খরচের দায়িত্বশীল, তারপর তোমার স্ত্রীর, তারপর সামর্থ্য হলে তোমার নিকটাত্মীয়ের খরচ তোমার ওপর বর্তাবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৯৯৭)

ইবন মুনযির রহ. বলেন,
أجمع أهل العلم على أن نفقة الوالدين الفقيرين اللذين لا كسب لهما ولا مال واجبة في مال الولد
ওলামায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, সন্তান যদি সামর্থ্যবান হয় এবং মা-বাবা যদি গরিব হয় তাহলে তাঁদের জন্য খরচ করা সন্তানের ওপর ওয়াজিব।(আল মুগনি ১১/৩৭৫)

ধরনের আরো অনেক দলীলের কারণে মুসলিম মনীষীগণ বিষয়ে একমত যে, পিতামাতা দরিদ্র হলে এবং পিতার নিজের কোনো উপার্জন না থাকলে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব সচ্ছল সন্তানের। (মুগনিল মুহতাজ /৫৬৯; আলমুগনী ১১/৩৭৩)

সমর্থ থাকা সত্ত্বেও সন্তানরা অভাবগ্রস্ত মাবাবার খরচ না দিলে গুনাহগার হবে। ক্ষেত্রে সন্তানরা স্বেচ্ছায় না দিলে অভাবগ্রস্ত মাতাপিতা ছেলেমেয়ের সম্পদ থেকে প্রয়োজন পরিমাণ তাদের অনুমতি ছাড়াও নিতে পারবেন। তবে মাবাবা বিত্তবান হলে অনুমতি ছাড়া ছেলেমেয়ের সম্পদ থেকে নেওয়া বৈধ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : /৫৬৪)

পিতা উপার্জনক্ষম হলেও সামর্থ্যবান সন্তানের কর্তব্য, পিতামাতার ভরণ পোষণের ভার বহন করা। যেন উপযুক্ত সন্তান থাকা অবস্থায় পিতাকে উপার্জনের জন্য কষ্ট করতে না হয়।মাবসূত সারাখসী /২২২; বাদায়েউস সানায়ে /৪৪৭; ফাতহুল কাদীর /২২০

মাতা-পিতা অমুসলিম হলেও প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁদের ভরণ-পোষণের ভার সন্তানকে বহন করতে হবে। সূরা লুকমান : ১৫; বাদায়েউস সানায়ে /৪৪৯; হেদায়াফাতহুল কাদীর /২২০

একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা থাকলে সচ্ছল বা উপার্জনক্ষম সন্তানের সবার ওপর অভাবী মাতা-পিতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তাবে।(মাবসুত সারাখসি : ৫/২২২)

ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

তাই কোনো মেয়ে যদি সামর্থ্যবান বিত্তবান হয়, তাহলে ছেলেদের মতো সমভাবে মেয়ের ওপরও মাবাবার খরচের দায়িত্ব বর্তাবে।

কেননা মাবাবার জীবিত অবস্থায় সন্তানের জন্য খরচ উপহারে মেয়েরাও তাদের ভাইদের মতো সমঅধিকারী, তাই মাবাবার খরচ বহনে তারাও সামর্থ্যের শর্তে তাদের ভাইদের সমদায়িত্বশীল হবে। ছেলেমেয়ে না থাকলে তারপর সিরিয়াল আসবে নাতিনাতনিদের। অতএব, তাদের ওপর সমভাবে দায়িত্ব বর্তাবে। (ফাতহুল কাদির : /৪১৭)

মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি—এ ধরনের ঊর্ধ্বতন আত্মীয়রা ভরণ-পোষণের অধিকারী হওয়ার জন্য শর্ত হলো দুটি—

এক. তাঁরা এমন দরিদ্র হতে হবে যে তাঁরা নিজের মালিকানার সম্পদে চলতে অক্ষম।

এখন কথা হলো, যদি তাঁরা উপার্জনের শক্তি রাখে, তাহলেও তাঁদের সন্তানদের ভরণ-পোষণ দিতে হবে কি না?

এ ক্ষেত্রে বিধান হলো, তাঁদের উপার্জনের শক্তি থাকলেও যদি তাঁদের কাছে চলার মতো নগদ টাকাকড়ি না থাকে, তাঁদের সন্তানদের ভরণ-পোষণ দিতে হবে। তাদের সন্তানরা এ কথা বলতে পারবে না যে আপনি তো উপার্জনে সক্ষম, আপনি নিজে উপার্জন করে চলুন। তবে যদি তাঁরা ধনী হন, তথা তাঁদের মালিকানায় নগদ এমন সম্পত্তি থাকে, যা দ্বারা তাঁরা শান্তিতে কালাতিপাত করতে পারেন, তাহলে সন্তানদের ওপর তাঁদের ভরণ-পোষণ দেওয়া ওয়াজিব নয়।

দুই. সন্তান-সন্ততি সামর্থ্যবান ও উপার্জনে সক্ষম হতে হবে।

তাদের সামর্থ্যবান হওয়ার পরিমাণ হলো, তাদের মালিকানার সম্পত্তি বা উপার্জনকৃত আয়ের দ্বারা নিজের ও নিজের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির স্বাভাবিক ভরণ-পোষণের পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকতে হবে। অন্যথায় তাদের উপার্জনকৃত আয়ের মধ্য থেকে যদি তার নিজের ও স্ত্রী বা সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত সম্পদ না থাকে, তাহলে মা-বাবা ও ঊর্ধ্বতন আত্মীয়ের ভরণ-পোষণ দেওয়া ওয়াজিব নয়।

যদিও এ ক্ষেত্রে উত্তম হলো, কষ্ট হলেও যথাসাধ্য মা-বাবারও ভরণ-পোষণের খরচ চালিয়ে যাবে। (তাবঈনুল হাকায়েক : ৩/৬৪, রদ্দুল মুহতার : ২/৬৭৮)

পুত্র অসচ্ছল হলে যদি তার উপার্জনের ক্ষমতা থাকে তাহলে তার কর্তব্য পিতামাতার জন্যও উপার্জন করা। নিজের প্রয়োজন এবং স্ত্রীসন্তান থাকলে তাদের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের পর অবশিষ্ট সম্পদ পিতামাতার জন্য খরচ করা ওয়াজিব। যদি কোনো কিছুই উদ্বৃত্ত না থাকে তাহলে অভাবী পিতামাতাকে নিজের পরিবারে শামিল করে নিবে। কারণ গোটা পরিবারের খাদ্যবস্ত্রে একজন বা দু জন মানুষকে শামিল করা অসম্ভব নয়।আলমুফাসসাল ১০/১৯৫

সারকথা;

পিতা-মাতার ভরণ পোষণের সামর্থ না থাকলে তাদের দায়িত্ব তাদের সন্তানের উপর সমান ভাবেই বর্তায়।

সুতরাং যেভাবে পুত্র সন্তান তার বাবা-মার দায়িত্ব নিবে, তদ্রুপ কন্যা সন্তানকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

কিন্তু পরিবারে যদি ছেলে সন্তান না থাকে, আর শুধু কন্যা সন্তান থাকে, বা ছেলে সন্তানের সামর্থ না থাকে, বা সে দায়িত্ব পালন না করে, এবং মা-বাবারও সামর্থ্য না থাকে তবে কন্যা সন্তান তার মা-বাবার দায়িত্ব পালন করবে।

মেয়ে নিজের মোহর থেকে অথবা নিজ মালিকানাধীন অন্য সম্পদ থেকে বাবামায়ের জন্য খরচ করবে।

যদি নিজ মালিকানাধীন সম্পদ না থাকে তাহলে স্বামীকে সহজে বুঝিয়ে যদি স্বামী দায়িত্ব নিতে পারে সন্তুষ্টি চিত্তে স্ত্রীর বাবা মাকে খরচ চালানোর জন্য টাকা দেয়, তবে তার উপার্জন করে খরচ বহন করা জরুরী না।

অন্যথায়, স্বামীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে শরীয়তের সীমায় বৈধ হয় এমন যে কোন কর্মসংস্থানে যোগ দিয়ে পুরোপুরিভাবে শরয়ী পর্দা মেনে উপার্জন করবে।

এক্ষেত্রে মেয়েরা ঘরোয়া পরিবেশে শিক্ষকতা করে বা কোন হস্তশিল্প (যেমন সেলাই এর কাজ) বা হাঁস মুরগী পালন করে তাদের সহযোগিতা করতে পারে।

আর যদি একান্ত বাহিরে গিয়ে উপার্জন করতে হয় তবে এর জন্য কিছু নিয়ম ও শর্ত রয়েছে।

নিয়ম ও শর্তগুলো মেনে চললে নারীর জন্য ঘর থেকে বের হওয়া জায়েয হবে; অন্যথায় নয়। 

যেমন,
– যদি সত্যিকারে তার চাকরি করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তার জন্য চাকরি করা জায়েয হবে।
– চাকরিটা তার দৈহিক, মানসিক স্বভাব ও রুচির সঙ্গে সামন্জস্যশীল হতে হবে। যেমন, ডাক্তারি, নার্সিং, শিক্ষা, সেলাই কিংবা এ জাতীয় পেশা হতে হবে।
– কর্মক্ষেত্রে পর্দার পরিপূর্ণ পরিবেশ থাকতে হবে। অন্যথায় জায়েয হবে না।
– চাকরির কারণে যাতে পরপুরুষের সঙ্গে সফর করতে না হয়।
– কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার পথে যাতে কোন হারাম কাজ করতে না হয়। যেমন, ড্রাইভারের সঙ্গে একাকী যাওয়া, পারফিউম ব্যবহার করা ইত্যাদি।
– নারীর প্রধান কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে স্বামীর খেদমত করা, তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা। যদি চাকরি করতে গিয়ে এসব দায়িত্ব পালনে ব্যাপক অসুবিধা হয় তাহলে তার জন্য চাকরি করা জায়েয হবে না। (ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ ২/৯৮১ ফিকহুন নাওয়াযিল ৩/৩৫৯)

ولها ان تقوم بالتدريس والبيع والشراء والصناعة من نسيج وصيغ وغزل وخياطة ونحو ذلك إذا لم يفض إلى مالا يجوز شرعا من خلوتها بأجنبى، أو اختلاطها برجال غير محارم اختلاطا تحدث منه فتنة أو يؤدى إلى فوات ما يجب عليها نحو اسرتها دون أن تقيم مقامها من يقوم بالواجب عنها ودون رضاهم (فقه النوازل-3/359

উল্লেখ্য, স্ত্রীর বাবামায়ের জন্য সামর্থ্য অনুপাতে খরচ করা স্ত্রীর উপর ওয়াজিব; স্বামীর উপর নয়। কেননা, শশুরশাশুড়ীর খরচ চালানো স্বামীর উপর আবশ্যক নয়। 

তবে, স্বামীর উচিত স্ত্রীর পরিবারকে সম্মান করা। তারা দরিদ্র হলে তাদেরকে সাহায্য করা; এমনকি সেটা নিজের যাকাত সদকা থেকে হলেও। বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যদি শশুরশাশুড়ীর খরচ চালানোর মত কেউ না থাকে।

স্মর্তব্য,

স্বামীর উপার্জন থেকে স্ত্রীর বাবা-মায়ের জন্য খরচ করলে কিংবা তাদেরকে স্ত্রীর শশুরবাড়িতে রাখলে স্বামীর মন খারাপ হবে তাহলে তার জন্য খরচ করা কিংবা তাদেরকে স্ত্রীর শশুরবাড়িতে রাখা জায়েয হবে না।

রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,

وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَهْىَ مَسْئُولَةٌ

একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি ৪৮০৯)

والله تعالى أعلم

উত্তর প্রদান-

Mufti Masum Billah

Facebook Comments Box