“গাইরাত” (الغيرة) একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ : আত্মমর্যাদাবোধ, protective jealousy (প্রটেকটিভ জেলাসি)
কারো জন্যে খাস বস্তুতে অন্য কেউ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করায় ওই ব্যক্তির ভিতর যে সংবেদনশীলতা বা উত্তেজনার তৈরি হয় তাই গাইরত। গাইরতের বহিঃপ্রকাশ সাধারনত ঘটে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে। (ফাতহুল বারিঃ পৃষ্টা ৩২০ ; খন্ডঃ৯)
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টাকে একটি ভালো এবং প্রয়োজনীয় গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়;
যা কিনা একজন পুরুষ তার স্ত্রী, কন্যা বা বোনের ক্ষেত্রে অনুভব করে ; যখন অন্য কোন নন-মাহরাম পুরুষকে তাদের সংস্পর্শে দেখে অথবা তাদের দিকে তাকাতে দেখে।
রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর তাঁর স্ত্রীদের (সম্মানের) প্রতি গাইরত অত্যন্ত বেশি ছিল এবং সাহাবাগণের মধ্যেও তা পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের প্রিয়নবী রসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং তার সাহাবাদের গাইরাত কেমন ছিলো তা সংক্ষেপে বর্ননা করছি।
একদা মুগীরা (রাঃ) এর সাথে কথা প্রসঙ্গে সা’দ ইবন উবাদা (রাঃ) বলেন,
আমি যদি আমার স্ত্রীর সাথে কোন পরপুরুষকে দেখি তাহলে আমি তাকে সোজা তরবারী দ্বারা আঘাত করে হত্যা করব।
তার এ উক্তিটি রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে পৌছালে তিনি বললেন:
أتعجبون من غيرة سعد لأنا أغير منه والله أغير مني
‘তোমরা কি সা’দ এর আত্মমর্যাদাবোধে বিস্মিত হচ্ছ? আল্লাহর কসম! আমি তার চেয়েও বেশি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। আর আল্লাহ্ আমার চেয়েও বেশি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। আল্লাহ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হওয়ার কারণে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য (সর্বপ্রকার) অশ্লীলতাকে হারাম করে দিয়েছেন।
[সহিহ বুখারী]
কুরআন, হাদীস, ফিকহ খুঁজলে কোথায়ও এই বিধান পাওয়া যাবে না যে, কেউ তার স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষকে দেখলে সে যেন তাকে হত্যা করে ফেলে।
এবং সা‘দ রাযি. যদি সত্যিই কোন গভীর অপরাধের স্বাক্ষপ্রমাণ ও শরয়ী বিচারিক সিদ্ধান্তের বাইরে এমনটি করে ফেলেন; তাহলে রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদালত তাঁরও বিচার করবে।
কিন্তু তারপরো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ রাযি. এর এই গাইরতকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বলেছেন –
আমি এর চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও সংবেদনশীল।
وَعَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا لَيْلًا قَالَتْ: فَغِرْتُ عَلَيْهِ فَجَاءَ فَرَأَى مَا أَصْنَعُ فَقَالَ: «مَا لَكِ يَا عَائِشَةُ أَغِرْتِ؟» فَقُلْتُ: وَمَا لِي؟ لَا يَغَارُ مِثْلِي عَلَى مِثْلِكَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَقَدْ جَاءَكِ شَيْطَانُكِ» قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَمْعِي شَيْطَانٌ؟ قَالَ: «نَعَمْ» قُلْتُ: وَمَعَكَ يَا رَسُولَ الله؟ قَالَ: «نعم وَلَكِن أعانني علَيهِ حَتَّى أسلَمَ» . رَوَاهُ مُسلم
’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘর হতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। এতে আমার ব্যথাতুর মনে ক্ষোভের উদ্রেক করে। পরক্ষণেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফিরে এসে আমাকে বিমর্ষ ভাব দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে ’আয়িশাহ্! কি হয়েছে তোমার? তোমার কি গাইরত বোধ হয়েছ?
আমি বললাম, আপনার মতো মানুষের প্রতি (সাহচর্য হতে বঞ্চিত হয়ে) আমার মতো নারী কি করে গাইরত বোধ না হয়ে থাকতে পারে?
এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাকে শায়ত্বন প্ররোচিত করেছে।
আমি (বিস্ময়াভিভূত হয়ে) জিজ্ঞেস করলাম- হে আল্লাহর রসূল! আমার সাথেও কি শায়ত্বন থাকতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিকটও শায়ত্বন আসতে পারে?
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, তবে তার বিরুদ্ধে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করায় আমি (তার ওয়াস্ওয়াসাহ্ হতে) নিরাপদপ্রাপ্ত হই।
– সহীহ মুসলিম ২৮১৫, আহমাদ ২৪৮৪৫।
হিজরি ২৮৬ সাল। আজ থেকে প্রায় ১২ শত বছর আগের কথা। তেহরানে অবস্থিত বর্তমান ‘রয়’ শহর তখন খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত। বহু বিখ্যাত মনিষীদের জন্মস্থান। তাদের পদচারণে মুখরিত শহরের প্রতিটি অলিগলি।
তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন মূসা বিন ইসহাক।
সেই বছর তাঁর আদালতে এক নারী মামলা টুকে। তাও আবার নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে। যাইহোক,
হাজিরার দিন নারীর পক্ষের উকিলকে ডাকা হলো। উকিল তার নারী মক্কেলের পক্ষ থেকে দাবী উপস্থাপন করল, মক্কেলকে মোহরানা বাবদ ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা স্বামীর পরিশোধ করতে হবে। মক্কেলের স্বামী তখন আদালতেই উপস্থিত। কিন্তু সে এত বড় অঙ্ক পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানালো।
বিচারপতি নারীর উকিলকে ডাকলেন। — তোমাদের সাক্ষীরা কোথায়? আদালতে এসেছে? — জি হুজুর, তারা সবাই এখানে উপস্থিত আছে।
তার আগে একটু বলে নিই, সেই বাদী নারী পর্দাবৃত ছিল এবং চেহারাও নিকাবে ঢাকা। কিন্তু আদালতে নিয়ম হচ্ছে, বাদীর দিকে তাকিয়ে সাক্ষীকে স্বীকৃতি দিতে হয় এবং সাক্ষ্যদান-কালে তার দিকে ইশারা করতে হয়। তাই উকিল সাহেব একজন সাক্ষীকে বলল, সে যেন সেই নারীর দিকে তাকায় এবং তার মক্কেলের চেহারা সনাক্ত করে।
এ কথা শুনে স্বামী উত্তেজিত হয়ে পড়ল। যদিও সে বিবাদী। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল: — এসব কী হচ্ছে! কী শুরু করলেন আপনারা!? — সাক্ষীরা আপনার স্ত্রীর চেহারা দেখবেন। যেন তাদের পক্ষে আপনার স্ত্রীর পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনের খাতিরেই এমনটা করা হচ্ছে। উকিল ব্যাখ্যা করল।
‘থামুন আপনারা।’ রাগে অগ্নিশর্মা স্বামী। ‘আমি বিচারক মহোদয়কে সামনে রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি, মোহরানা বাবদ আমার স্ত্রী যে পরিমাণ অর্থ দাবি করেছে, আমি পুরোটাই পরিশোধ করতে রাজি; তবুও সে যেন তার নিকাব না সরায়!’
স্বামীর গাইরত (আত্মমর্যাদা) দেখে স্ত্রীও বলে উঠল, ‘আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমার মোহর তাকে দান করে দিলাম। সেই সাথে দুনিয়া ও আখিরাতে এ ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে তাকে দায়মুক্ত ঘোষণা দিলাম!’
স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল গোটা আদালত। এ কী বলছে তারা! বিচারক মূসা বিন ইসহাক বিস্ময়-সুরে বলেই উঠলেন, ‘আপনাদের দুজনের গাইরত দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। বইপত্রে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হোক। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, মুসলিমদের আখলাক কেমন ছিল।’
উল্লেখ্য, রয় নগরী। এটি প্রাচীন খোরাসানের একটি শহর। বর্তমানে এটি ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর শাসনামলে নুয়াইম বিন মুকাররিন এই শহরটি জয় করেন। এ শহর অনেক বড় বড় মুসলিম পণ্ডিত জন্মদান করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রসিদ্ধ তাফসিরবিদ ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি রহ.।
সূত্র : তারিখু বাগদাদ : ১৫/৩৫, খতিব আবু বকর আল বাগদাদি (৩৯২-৪৬৩ হি.)।
এটা ঈমানদারের আত্মমর্যাদা। ঈমানের একটা স্বাভাবিক চাহিদা।
অথচ
যুগের পরিক্রমায়, আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আজ সেই লজ্জা আমরা হারাতে বসেছি। ভুলে গিয়েছি নিজেদের পরিচয়, শান-সৌকত।
আত্মমর্যাদাবোধ তো একজন সুস্থ মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঈমানী দুর্বলতার কারণে কারো মধ্যে যদি ‘ঈমানী গাইরত’ না-ও থাকে, একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে অন্তত আত্মমর্যাদাবোধ তো থাকতে হবে।
যে ব্যক্তি মুসলিম নাম-পরিচয় ধারণ করেছে, মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে এবং মুসলিম পরিবারে আত্মীয়তা করেছে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় মুসলমানদেরই যে পাশে পেয়েছে, পর্বে-উৎসবে, জীবনের নানা অনুষঙ্গে মুসলিম-সমাজের একজন হিসেবেই জীবন যাপন করেছে, এরপরও, এত বন্ধন ও সম্বন্ধের পরও যদি এই ধর্ম, এই সমাজের প্রতি তার কিছুমাত্র মমতা না থাকে, এই সমাজ ও ধর্মের অবমাননা যদি না হয় তার নিজের অবমাননা তাহলে এ ব্যাক্তিকে আর যা-ই বলা যাক, একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় কি?
আমাদের দুর্ভাগ্য যে,
মুসলিম-সমাজে বিভিন্ন নামে ও শিরোনামে একদিকে চলছে অন্যায় অহমিকার শিক্ষা এবং বিভেদ-বিভক্তিকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা।
অন্যদিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও উদারনৈতিকতার নামে দেয়া হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম বিষয়ে চরম হীনম্মন্যতা ও চূড়ান্ত নির্লিপ্ততার দীক্ষা।
গাইরতহীন নারী আর পুরুষে দেশ ভরে গেছে, কারো মধ্যে বিন্দু মাত্র গাইরাত বোধ নাই।
এমনকি নিজের স্পাউজ (স্বামী/স্ত্রী) নিজের ছেলে/মেয়ে কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, ছবি তুলছে, পাশাপাশি বসছে, আড্ডা দিচ্ছে,
এগুলোতে তাদের কিছুই মনে হয় না।
নাউযুবিল্লাহ!
ফলে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনায় ছেয়ে যাচ্ছে এই উম্মাহ। যেই জাতি তাদের নারীদের চেহারাটুকু পর পুরুষদের দেখতে দিত না, সেই জাতিই আজ অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় তাদের বাহিরে যেতে দেয়।
অবাধ মেলামেশা, অশ্লীলতার মতো কুৎসিত অভ্যাসে যারা অভ্যস্ত, পশ্চিমাদের নির্ধারিত নৈতিকতার মানদণ্ডে যারা নিজেদের মস্তিষ্ককে বাক্সবন্দী করে রেখেছে,
তাদেরকে কীভাবে বোঝাবেন তাদের আসল সম্মান কোথায়?
কীভাবে তাদেরকে আসল স্বাধীনতা চেনাবেন, অথচ প্রবৃত্তির কাছে তাদের বিবেক নতিস্বীকার করেছে?
ভোগবাদী জীবনকেই সাফল্য হিসেবে নিয়েছে?
একজন মুমিন কীভাবে এটা সহ্য করে যে,
তার স্বামী/ স্ত্রী, পুত্র/কণ্যা, বা ভাই/বোন ট্যুরের নাম করে অন্য পুরুষের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে, নানা ইভেন্টে অংশ নেয় এবং অর্ধনগ্ন হয়ে নাগিনি ড্যান্স এর সাথে হলি উদযাপন করে। আবার এসব কিছুর ভিডিও অনলাইনে ঘুরে বেড়ায়।
আপসোস!
ঈমানের গায়রত কতটা তলানীতে গেলে একজন মুমিন অভিভাবক এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে, অনায়াসে সয়ে যায়।
এ পরিস্থিতিতে কোনো মুসলিমের কণ্ঠ যখন সোচ্চার হয় ইসলাম ও মুসলিমের উপর কৃত কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিংবা ধ্বণিত হয় কোনো সত্য-সাহসী উচ্চারণ তখন তাকে সম্মান জানাতে ইচ্ছে করে।
ঈমানী গাইরত থেকে হলে মুমিন হিসেবে, নতুবা একজন সুস্থ ও পরিণত মানুষ হিসেবে।
হাম আযিয ও মাগলুব কু নুস্রত তেরি নুসরত তেরি
রাখুন আদাওয়াত হো মগর গাইরত তেরি গাইরত তেরি
অর্থঃ
আমাদের ন্যায় অক্ষম ও পরাজিতদের পুনঃপুন সাহায্য প্রয়োজন। শত্রুদের পক্ষ হতে নানান ধরনের শত্রুতা পোষণ করা হলেও একমাত্র তোমার গাইরত তথা সত্তার সম্মানে ধৈর্য ধারণ করে যাচ্ছি।
আসুন,
গাইরাত বোধ সজাগ করি, যা প্রত্যেক মুসলিমের ; বরং মানুষের থাকা উচিত।
হে আমার প্রিয় ঈমানদার ভাই- বোনেরা !
সতর্ক হোন,
আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন।
ভয় করুন সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।
- মুফতী মাসুম বিল্লাহ।
Sharia Specialist, Islamic Economist, Banking & Finance Expert.
Khatib & Mufassir at Al Madina Jame Masjid at Eastern Housing, Pallabi Phase-2, Mirpur 11 ½.
Senior Muhaddis & Mufti at Jamia Islamia Darul Uloom Dhaka,Masjidul Akbar Complex, Mirpur-1,Dhaka-1216
Ustazul fiqh & Ifta at مركز البحوث الاسلامية داكا. Markajul Buhus Al Islamia Dhaka