প্রশ্ন: টিকা বা ভ্যাকসিন গ্রহণের শরয়ী বিধান কি? জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তর: وبالله سبحانه التوفيق
টিকা বা ভ্যাকসিন চিকিৎসা নয়, তবে প্রতিষেধক বা অগ্রিম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
ঔষধ প্রয়োগ করা হয় রোগ মুক্তির জন্য, পক্ষান্তরে টিকা দেয়া হয় রোগাক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য। অর্থাৎ টিকা গ্রহণের উদ্দেশ্য সতর্কতা অবলম্বন; রোগমুক্তি নয়। তাই এটিকে সে অর্থে চিকিৎসাও বলা যায় না। এজন্যেই জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসা বিষয়ক শরীয়তের ছাড়গুলোর সবক’টি টিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।
ইসলাম মানুষকে এমন কিছু ব্যবহারের অনুমোদন দেয় না, যা তার জন্য প্রাণহানীকর অথবা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর কারণ। সে দৃষ্টিতে কোনো টিকা নেওয়ার পূর্বেই তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া দরকার এবং ব্যবহারকারীর জন্য স্বাস্থ্যগত দিক থেকে উপযুক্ত কি না তা জেনে নেওয়া আবশ্যক।
টিকার শরঈ বিশ্লেষণে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া দরকার তার হলো:
১. এর উপাদানগুলোতে শরীয়ত-নিষিদ্ধ কিছু রয়েছে কি না।
২. এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
৩. কী উদ্দেশ্যে টিকা নেয়া হবে, ইত্যাদি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা চিকিৎসা করাও। তবে হারাম বস্ত্ত দিয়ে করো না’। (আহমাদ হা/১২৬১৮)।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহ এমন কোন রোগ নাযিল করেননি যার প্রতিষেধক সৃষ্টি করেননি। যারা এবিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার তারা করল। আর যারা অজ্ঞ থাকার তারা অজ্ঞই থাকল। (আহমাদ হা/৩৫৭৮)।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে। যখন সেটা পৌঁছে যায়, তখন সে রোগমুক্ত হয় আল্লাহর হুকুমে। (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৫১৫)।
উপরোক্ত হাদীসসমূহ ও মূলনীতির আলোকে –
যদি বিশেষ কোনো ওষুধ বা ভ্যাক্সিন সম্পর্কে সঠিক তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞ স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে বা প্রবল ধারণা মতে প্রমাণিত হয় যে— এটা ক্ষতিকারক, বা তাতে হারাম উপাদান আছে তাহলে শুধু রোগপূর্বক চিকিৎসার জন্য এ ভ্যাকসিন গ্রহণ অবৈধ। এবং তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কেননা, জেনে-বুঝে ক্ষয়-ক্ষতি ও ধ্বংস ডেকে আনা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আর যদি মুসলিম প্রকৃত দ্বীনদার ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ও সত্যায়নে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় নিশ্চিতভাবে বা প্রবল ধারণা মতে প্রমাণিত হয় যে, তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় ও তাতে হারাম উপাদান নাই তাহলে এ ভ্যাকসিন গ্রহণ বৈধ।
সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন বিষ এবং যাদু তার কোনো ক্ষতি করবে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৭৬)
এ হাদিসে তিনি অগ্রিম প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এছাড়াও তিনি সকাল-সন্ধ্যা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর এবং ঘুমানের পূর্বে বিভিন্ন দোয়া ও জিকির শিক্ষা দিয়েছেন, যেন মানুষ জিন-শয়তান, যাদু ও বদনজর ইত্যাদি থেকে রক্ষা পায়। এগুলোও অগ্রিম প্রতিরোধ মূলক উপায়।
তবে এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে অবশ্যই এ বিশ্বাস ও ঈমান রাখতে হবে যে, ভালো-মন্দ, রোগাক্রান্ত হওয়া বা রোগমুক্ত থাকা সবকিছুর মূল শক্তি আল্লাহর হাতে। আল্লাহ না চাইলে তার ক্ষেত্রে দুআ, যিকির, ঔষধ, টিকা ইত্যাদি কিছুই কার্যকর হবে না। দুআ যিকির, ঔষধ বা টিকা কাজ করলে তা একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাতে এবং তাঁর অনুগ্রহেই করেছে।
মনে এমন ভাবনা আনা যাবে না যে, এই ব্যবস্থা গ্ৰহণ করলেই আমি বেঁচে থাকব, আর গ্ৰহণ না করলেই আমি মৃত্যু বরণ করব।
কারণ, মুসলমানদেরকে সবসময় দৃঢ়ভাবে এমন বিশ্বাস পোষণ করে চলতে হবে যে, জীবন-মৃত্যুসহ সকল কিছুর চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া এক ধুলিকণাও এদিক-ওদিক হওয়ার ক্ষমতা রাখে না।
সুতরাং সঠিক নিয়তে ব্যবহার করলে টিকা ‘তাওয়াক্কুল’ পরিপন্থী নয়। কারণ টিকা গ্রহণকারী তা ব্যবহারই করবে ওসিলা হিসেবে। তার বিশ্বাস, মূল কার্যক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার।
সুতরাং, যদি টিকা বা ভ্যাকসিন এর কারণে মানুষের জীবন বা তার কোনও শক্তি ও আচরণে বিরূপ প্রভাব না পড়ে, কোন ক্ষতি না হয়, তবে এর ব্যবহারে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই।
আর চিকিৎসাগতভাবে কী প্রভাব পড়তে পারে- এটা কেবল চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামত দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
তবে হারাম উপাদান থাকার শুধু সন্দেহের কারণে তা হারাম বলা যাবে না। যতক্ষণ না ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিষয়টি নিশ্চিত না করে বা কেউ পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে কোনও প্রত্যয়িত প্রতিবেদন জমা না দেয়।
বাকি রইল, লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে যদি দু-চারজনের ভ্যাকসিন ব্যবহারের পর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, তো এটি কোনও দলিল নয়। কারণ, প্রতিনিয়ত যে ওষুধগুলি ব্যবহার করা হয়, মাঝে-মধ্যে তাতেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে এবং অনেক মৃত্যুও ঘটে যায়।
সুতরাং কতিপয়ের ক্ষতির দ্বারা অবৈধ সাব্যস্ত হবে না।
টিকা বা ভ্যাকসিন গ্রহণ করা মুবাহ তথা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কিন্তু এটি নেয়া আবশ্যক বা উত্তম এমন কিছুই নয়। তাই কেউ না নিতে চাইলে তাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে সমস্যা নেই। তবে যে নেবে সে নিয়ত ও উদ্দেশ্য সহীহ করে নেবে।
আর হ্যাঁ, তদুপরি কেউ যদি সতর্কতামূলক বিরত থাকতে চায় সেটার সুযোগ আছে। والله تعالى أعلم
প্রসঙ্গত, একটি মুসলমান প্রধান দেশ, যাতে কোটি কোটি লোকদের ভ্যাকসিন দেয়া হবে। তা আমদানি ও প্রদানের সিদ্ধান্তের পূর্বে যদি নির্ভরযোগ্য আলেমদের মাধ্যমে আগেই এর শরীয়া বিষয়গুলো নিশ্চিত করে নেয়া হয় তাহলে তা কতই না ভাল হয়।
قوله تعالى: إنما حرم عليكم الميتة والدم ولحم الخنزير وما أهل به لغير الله فمن اضطر غير باغ ولا عاد فلا إثم عليه إن الله غفور رحيم) [البقرة: 173]
الأصل في الأَشْيَاءِ الْإِبَاحَةُ، وَأَنَّ فَرْضَ إِضْرَارِهِ لِلْبَعْضِ لَا يَلْزَمُ مِنْهُ تَحْرِيمُهُ عَلَى كُلِّ أَحَدٍ، فَإِنَّ الْعَسَلَ يَضُرُّ بِأَصْحَابِ الصَّفَرَاءِ الْغَالِبَةِ، وَرُبَّمَا أَمْرَضَهُمْ مَعَ أَنَّهُ شِفَاءٌ بِالنَّصَّ الْقَطْعِيِّ، وَلَيْسَ الاختياطُ فِي الافْتِرَاءِ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى بِإِثْبَاتِ الْحُرْمَةِ أَوْ الْكَرَاهَةِ اللَّذَيْنِ لَا بُدَّ لَهُمَا مِنْ دَلِيلٍ، بَلْ فِي الْقَوْلِ بِالْإِبَاحَةِ الَّتِي هي الأضل”. (حاشية ابن عابدين (رد المحتار)، 6 / 459،كتاب الاشربہ، ط سعید
وفي الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (1/210):
اختلف في التداوي بالمحرم، وظاهر المذهب المنع كما في”رضاع البحر، لكن نقل المصنف ثمة وهنا عن الحاوي وقيل: يرخص إذا علم فيه الشفاء ولم يعلم دواء آخر كما رخص الخمر للعطشان، وعليه الفتوى…..
للعطشان في الضرورة، وكذا اختاره صاحب الهداية في التجنيس فقال: لورعف فكتب الفاتحة بالدم على جبهته وأنفه جاز للاستشفاء … وهذا ؛ لأن الحرمة ساقطة عند الاستشفاء كحل الخمر والميتة للعطشان والجائع . اهـ من البحر.
وأفاد سيدي عبد الغني أنه لا يظهر الاختلاف في كلامهم لاتفاقهم على الجواز للضرورة، واشتراط صاحب النهاية العلم لا ينافيه اشتراط من بعده الشفاء ولذا قال والدي في شرح الدرر إن قوله: لا للتداوي محمول على المظنون وإلا فجوازه باليقيني اتفاق كما صرح به في المصفى. اهـ. أقول: وهو ظاهر موافق لما مر في الاستدلال، لقول الإمام: لكن قد علمت أن قول الأطباء لا يحصل به العلم. والظاهر أن التجربة يحصل بها غلبة الظن دون اليقين إلا أن يريدوا بالعلم غلبة الظن وهو شائع في كلامهم، تأمل. (قوله : وظاهر المذهب المنع محمول على المظنون كما علمته (قوله: لكن نقل المصنف إلخ) مفعول نقل قوله وقيل: يرخص إلخ والاستدراك على إطلاق المنع، وإذا قيد بالمظنون فلا استدراك. ونص ما في الحاوي القدسي إذا سال الدم من أنف إنسان ولا ينقطع حتى يخشى عليه الموت وقد علم أنه لو كتب فاتحة الكتاب أو الإخلاص بذلك الدم على جبهته ينقطع فلا يرخص له فيه؛ وقيل: يرخص كما رخص في شرب الخمر للعطشان وأكل الميتة في المخمصة، وهو الفتوى. اهـ (قوله : ولم يعلم دواء آخر) هذا المصرح به في عبارة النهاية كما مر وليس في عبارة الحاوي، إلا أنه يفاد من قوله: كما رخص إلخ؛ لأن حل الخمر والميتة حيث لم يوجد ما يقوم مقامهما أفاده ط. قال: ونقل الحموي أن لحم الخنزير لا يجوز التداوي به وإن تعين، والله تعالى أعلم”. فقط .
উত্তর প্রদানে-
মুফতী মাসুম বিল্লাহ
সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুফতী,
জামিআ ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মসজিদুল আকবার কমপ্লেক্স মিরপুর-১ ঢাকা
ও মারকাযুল বুহূস আল-ইসলামিয়া ঢাকা।
খতীব, আল মদিনা মসজিদ, এল ব্লক, ইস্টার্ন হাউজিং, রূপনগর, মিরপুর ঢাকা।
চেয়ারম্যান, শারীয়াহ এ্যাডভাইজারি এন্ড রিসার্চ কাউন্সিল (এসএআরসি)।
Sharia Specialist, Islamic Economist, Banking & Finance Expert.
Khatib & Mufassir at Al Madina Jame Masjid at Eastern Housing, Pallabi Phase-2, Mirpur 11 ½.
Senior Muhaddis & Mufti at Jamia Islamia Darul Uloom Dhaka,Masjidul Akbar Complex, Mirpur-1,Dhaka-1216
Ustazul fiqh & Ifta at مركز البحوث الاسلامية داكا. Markajul Buhus Al Islamia Dhaka