রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি আমল।এটি রমজান মাসের সামগ্রিক কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য অপূর্ব বলিষ্ঠ সহায়ক শক্তি।
বিশেষত হাজার মাস বা ৮৩.৩৩ বছর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে ইতিকাফ।
বান্দা ই’তেকাফে বসবে একমাত্র আল্লাহ পাকের সঙ্গে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে৷ ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়।
ইতিকাফে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার সবকিছুর চিন্তা থেকে মনকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কেবল আল্লাহর ধ্যান-খেয়ালে মগ্ন থাকতে হবে। তবেই ইতিকাফ সম্পূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়।
ইতিকাফ শুধু পুরুষের জন্য নয়। নারীদেরও ইতিকাফের সুযোগ রয়েছে।
আর নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন।
তাই সুযোগ ও অনুমতি থাকলে নারীদেরও ইতেকাফ করা উত্তম।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন- ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০৩৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৭২)
“আউনুল মাবূদ” গ্রন্থে আছে-
“এ হাদিসে দলীল পাওয়া যায় যে ইতিকাফের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান।”
বিবাহিত নারী ইতিকাফ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ করা যাবে না।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতেকাফ করার ইচ্ছা করলেন। এরপর যে স্থানে ইতেকাফ করার ইচ্ছা করেছিলেন সেখানে এসে কয়েকটি তাঁবু দেখতে পেলেন। (তাঁবুগুলো হল নবিজীর সহধর্মিণী) আয়েশা, হাফসা ও যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহুন্নার তাঁবু। তখন তিনি বললেন, তোমরা কি এগুলো দিয়ে নেকি হাসিলের ধারণা কর? এরপর তিনি চলে গেলেন আর ইতেকাফ করলেন না। পরে শাওয়াল মাসে দশ দিনের ইতেকাফ করলেন।।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রমজানের শেষ দশকে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফ করতেন। আমি তাঁর তাঁবু তৈরি করে দিতাম। তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন। (নবিজীর সহধর্মিণী) হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁবু খাটাবার জন্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলে হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁবু খাটালেন। (নবিজীর সহধর্মিনী) যয়নব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহা তা দেখে আরেকটি তাঁবু তৈরি করলেন। সকালে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁবুগুলো দেখলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কী? তাঁকে জানানো হলে তিনি বললেন, ‘তোমরা কি মনে কর এগুলো দিয়ে নেকি হাসিল হবে? এ মাসে তিনি ইতেকাফ ত্যাগ করলেন এবং পরে শাওয়াল মাসে দশ দিন (কাযা স্বরূপ) ইতেকাফ করেন।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
হাদিসের আলোকে বুঝা যায়,
নারীর জন্য ইতেকাফ করায় স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতেকাফ বৈধ হবে না।
অবিবাহিতা নারী যদি তার অভিভাবকের পরামর্শে ও অনুমতিক্রমে ইতিকাফ করে, তাহলে অনেক উত্তম। হ্যাঁ, যে মহিলা অবসর তার জন্য কারো পরামর্শ ব্যতীত এতেকাফ করা বৈধ।
নারীরা ঘরেই ইতিকাফ করবেন।
ফলে নিয়ম মেনে সংসারের খোঁজখবরও নিতে পারবেন। সংসার ঠিক রেখে তাদের ইতিকাফও হয়ে যাবে।
সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই উচিত নয়।
যেসব নারীরা ইতেকাফ করতে চায়, তারা ঘরে নামাজের নির্ধারিত একটি স্থানে ইতেকাফ করবেন।
নারীদের ইতিকাফের স্থান তাদের নামাজের স্থান তাদের ঘরের অন্দরমহল; মসজিদ নয়।
নারীদের ঘর মসজিদের সদৃশ বলে পরিগণিত। তাই নারী ঘরে তাদের নামাজ আদায়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবেন।
যদি ঘরে নামাজের নির্ধারিত স্থান না থাকে, তবে যে কোনো একটি জায়গাকে ইতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। এরপর সেখানে ইতিকাফ করবেন।
নির্জন কক্ষের অভাবে কাপড় দিয়ে ঘিরে পর্দা করে নিতে পারেন।
আবু দাউদের (২১১৫) হাদিসে আছে, لا يخرج لحاجة إلا لما لا بد منه একান্ত বাধ্য না হলে বের হবে না।
মহিলারা ঘরের যে স্থানটিকে ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত করবেন তা তাদের ক্ষেত্রে মসজিদের মতোই গণ্য হবে।
প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তারা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে ঘরের অন্যত্র গেলেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
(ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮২)
মহিলারা ইতিকাফ অবস্থায় ঘরের নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে শুরু কেবল প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হতে পারবেন। অজুর জন্যও বাইরে যেতে পারবেন। খাবার পৌঁছে দেয়ার লোক না থাকলে খাবার আনার জন্য বাইরে যেতে পারবেন।
(বাদায়ে ২/২৮২, হেদায়া /২৩০, শামী ৩/৪৩৫)
প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হলে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন না। তবে দরকার হলে ওই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবেন এবং কেউ ভেতরে এলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবেন।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। -সুনানে আবু দাউদ: ২৪৭২
তবে কারও সঙ্গে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য ইতিকাফের স্থানের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েজ হবে না।
ইতিকাফ কক্ষে এমন কেউও অবস্থান করতে পারবেন যারা ইতিকাফ করছেন না। ইতিকাফ কক্ষটি যদি শয়নকক্ষ হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করেন তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন, তবে স্বামী-স্ত্রী সুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
পানাহার ইতিকাফের জায়গায় অর্থাৎ নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে করতে হবে। বাইরে করা যাবে না। (হেদায়া ১/২৩০)
ইতিকাফের জায়গায় থেকে অন্যদের সাংসারিক কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া যাবে। বাইরে যাওয়া যাবে না। রান্না-বান্নার লোক না থাকলে ইতিকাফের স্থান থেকে রান্না-বান্নার কাজ সম্ভব হলে করা যাবে। (মাহমুদিয়া ১৫/৩৩৪)
ইতিকাফের সময় ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। যেমন–
ইস্তিগফার, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, তাফসির, ইসলামি পুস্তক পাঠ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে রাত জেগে তারাবির নামাজ, তাহাজ্জুদের নামাজসহ অন্য নফল নামাজ, দরুদ শরিফ বিভিন্ন দোয়া রোনাজারির মধ্যে সময় অতিবাহিত করতে পারেন।
নারীরা ইতিকাফে বসার আগে অগ্রিম সংসারের কাজকর্ম সম্পাদন করে রাখি। তবে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
খুব সমস্যা থাকলে ১০ দিনের কমও করা যেতে পারে। তবে স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ করা যাবে না।
নারীদের ইতিকাফে বসার আগেই তাদের ঋতুস্রাবের দিন-তারিখ হিসাব করে বসা উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর পিরিয়ড শুরু হয়ে না যায়।
ইতিকাফ শুরু করার পর ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। পরে শুধু একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫০২)
তবে কারও রমজানের শেষ দশকে পিরিয়ড হওয়ার নিয়ম থাকলে তিনি পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতে পারবেন।
ওষুধ-বড়ি খেয়ে ঋতুস্রাব বন্ধ রেখে রোজা রাখলে এবং ইতিকাফ করলে রোজা ও ইতিকাফ সহিহ হবে।
তবে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিধায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
হায়েজ ব্যতীত ইস্তিহাজার সমস্যা থাকলেও ইতিকাফ করা যাবে। ইস্তিহাজা হলো, নারীরা মাঝেমধ্যে হায়েজের মতো বিভিন্ন রক্ত বা এ জাতীয় জিনিস দেখতে পান। এগুলো আবার হায়েজের রক্তের মতো না। এমতাবস্থায় ইতিকাফ করতে সমস্যা নেই। কারণ এই অবস্থায় নামাজ বা রোজা দুটোই ফরজ। সহিহ বুখারিতে এসেছে, নবিজির একজন স্ত্রী ইস্তিহাজা অবস্থায় ইতিকাফ করেছিলেন। [সহীহ বুখারি, ২০৩৭]
যে নারীর স্বামী বৃদ্ধ বা অসুস্থ কিংবা তার ছোটছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফ করার চেয়ে তাদের সেবাযত্ন করা উত্তম।
(উমদাতুল ক্বারী ১১/১৪৮; মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৪৪৬; হেদায়া ১/২৩০; মাবসূতে সারাখসী ৩/১১৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/১১৩; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১; আওজাযুল মাসালিক ৫/৪৬১-৪৬৬; ফাতাওয়া দারুল উলূম যাকারিয়া ৪/৬৯৯)
স্বামীদের উচিত, যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের ইতিকাফে বাধা না দেওয়া। তাদের ইতিকাফের সুযোগ করে দেওয়া। এতে উভয়ই সওয়াব পাবেন।(রদ্দুল মুহতার ২/৪৪১; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১)
স্বামী স্ত্রীকে ইতিকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪১; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১)
রাসূল (সা.) যেহেতু নিজ স্ত্রীদের ইতিকাফ করার অনুমতি দিয়েছেন তাই আমাদেরও এ বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা নারীদের ইতেকাফ করার তাওফিক দান করুন।
সব পুরুষকে নারীদের ইতেকাফে উৎসাহিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সংকলনে- মুফতী মাসুম বিল্লাহ।
Sharia Specialist, Islamic Economist, Banking & Finance Expert.
Khatib & Mufassir at Al Madina Jame Masjid at Eastern Housing, Pallabi Phase-2, Mirpur 11 ½.
Senior Muhaddis & Mufti at Jamia Islamia Darul Uloom Dhaka,Masjidul Akbar Complex, Mirpur-1,Dhaka-1216
Ustazul fiqh & Ifta at مركز البحوث الاسلامية داكا. Markajul Buhus Al Islamia Dhaka