যিলহজ্জ মাস গুরুত্ব-ফযীলত; আমল-করণীয়

By | July 11, 2021

রমাযানের পর বান্দা আবার গোনাহের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে মাগফিরাত-রহমতের ভিখারী!

আর এই মাগফিরাত-রহমত দানের জন্যই আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি কিছু সময়কে বিশেষ মর্যাদা ও সুযোগপূর্ণ করে দান করেছেন।

এমনকি কিছু সময়, কিছু দিন এমন রয়েছে, যা অন্য সময়ের চেয়ে অধিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও মহিমাময়।

‘আশারায়ে যিলহজ্ব’ ও ‘আইয়ামে তাশরীক’ অর্থাৎ যিলহজ্বের প্রথম তেরটি দিন এমনি মহিমান্বিত ও অর্জনের মৌসুম।

কেননা যিলহজ্বের এই প্রথম দশকে এমন দু’টি ইবাদত রয়েছে যা পুরো বছরের অন্য কোনো সময় আদায় করা সম্ভব নয়। এমনকি রমযানেও নয়। এই দু’টি ইবাদতের জন্য আল্লাহ তাআলা আশরায়ে যিলহজ্বকেই নির্বাচন করেছেন।

এই দু’টি ইবাদতের একটি হল হজ্ব, আর দ্বিতীয়টি কুরবানী।

কুরবানী যদিও ১১ ও ১২ যিলহজ্বেও দেওয়া যায়, কিন্তু বছরের অন্য কোনোদিন এই ওয়াজিব কুরবানী সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে রমযানের শেষ দশকের চেয়ে আশরায়ে যিলহজ্বের হজ্ব ও কুরবানীর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়; বরং বেশিই।

এ বিষয়ে বিশুদ্ধতম মত হল,

সামগ্রিক বিচারে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমযানের শেষ দশকের দিবসসমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমযানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন।

ইবনে রজব রহ. বলেন:

“যখন রাত্র উল্লেখ করা হয় তখন দিবসগুলোও তার মাঝে গণ্য করা হয়। এমনিভাবে, যখন দিবস উল্লেখ করা হয় তখন তার রাত্রিগুলো তার মাঝে গণ্য হয়; এটাই নিয়ম।এ ক্ষেত্রে শেষ যুগের উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে। তাহল, সামগ্রিক বিচারে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমযানের শেষ দশকের দিবসসমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমযানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন।”

قال الحافظ ابن كثير في “تفسيره”: وبالجملة: فهذا العشر قد قيل: إنه أفضل أيام السنة، كما نطق به الحديث، ففضله كثير على عشر رمضان الأخير؛ لأن هذا يشرع فيه ما يشرع في ذلك، من صيام وصلاة وصدقة وغيره، ويمتاز هذا باختصاصه بأداء فرض الحج فيه. وقيل: ذاك أفضل لاشتماله على ليلة القدر، التي هي خير من ألف شهر. وتوسط آخرون فقالوا: أيام هذا أفضل، وليالي ذاك أفضل. وبهذا يجتمع شمل الأدلة، والله أعلم.

সহীহ হাদীসে জিলহজের প্রথম দশ দিনের যথেষ্ট ফযীলত ও গুরুত্ব এসেছে। এ দশ দিনকে বছরের শ্রেষ্ঠ দিন বলা হয়েছে। উক্ত দশ দিনের আমল আল্লাহ তাআলার কছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় বণির্ত হয়েছে।

তাই যিলহজ্জ মাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

রমাযানের পরে এমন ইবাদতের মাস আর নাই বললে চলে।

আসুন !

এ মাসের কিছু আমলের বিষয়ে জেনে নেই।

১. গোনাহ না করা, গোনাহ পরিত্যাগ করা—

মহান আল্লহ তাআলা সব মাসেই গোনাহ করতে নিষেধ করেছেন, তবে পবিত্র মাসগুলোতে গোনাহের নিষেধাজ্ঞা বিশেষভাবে উল্লেখ করায় এই নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আল্লহ তাআলা ইরশাদ করেন—

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ ۚ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ

নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হইতেই আল্লাহ্‌র বিধানে আল্লাহ্‌র নিকট মাস গণনায় মাস বারটি; তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, ইহাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং ইহার মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করিও না এবং তোমরা মুশরিকদের সঙ্গে সর্বাত্নক ভাবে যুদ্ধ করিবে, যেমন তাহারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক ভাবে যুদ্ধ করিয়া থাকে। এবং জানিয়া রাখ, আল্লাহ্ তো মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন । ⁃ সূরা তাওবাহ-৩৬।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনা অনুযায়ী চারটি সম্মানিত মাস হচ্ছে, জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব।

ইমাম জাসসাস রহ. বলেন, ‘তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না’ কুরআনের এই বাক্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ মাসগুলোর এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার ফলে এতে ইবাদত করা হলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও ইবাদাতের তওফিক ও সাহস লাভ করা যায়। অনুরূপ এ মাসগুলোতে পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে বছরের অন্যান্য মাসগুলোতেও পাপাচার থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। তাই এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থাকা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। -আহকামুল কুরআন

হজরত মুআয রা. হতে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘তোমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, গুনাহের কারণে আল্লাহর আজাব নেমে আসে’। -মুসনাদে আহমদ: ২১৫৭০

• হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ: أَلَا إِنَّ أَحْرَمَ الْأَيَّامِ يَوْمُكُمْ هَذَا، وَإِنَّ أَحْرَمَ الشُّهُورِ شَهْرُكُمْ هَذَا. رواه أحمد، صحيح.

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

শুনে রাখ! নিশ্চয় সকল দিবসের মধ্যে পবিত্রতর ও মহিমান্বিত দিবস হল তোমাদের এই দিবস, এবং নিশ্চয় সকল মাসের মধ্যে পবিত্রতর ও মহিমান্বিত মাস হল তোমাদের এই মাস। ⁃ মুসনাদে আহমাদ, সনদ সহীহ।

২. আশারায়ে যিলহজ্ব’ বা দশদিনের গুরুত্ব ও আমল

‘আশারায়ে যিলহজ্ব’ বছরের শ্রেষ্ঠ দশক

যিলহজ্বের প্রথম দশককে পরিভাষায় ‘আশারায়ে যিলহজ্ব’ বলে। এই দশ দিন হচ্ছে বছরের সর্বোত্তম দশ দিন।

স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে এ দশ রজনীর কসম খেয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ

(১) শপথ ফজরের

(২) শপথ দশ রাত্রির, শপথ তার,

(৩) যা জোড় ও যা বেজোড়

(৪) এবং শপথ রাত্রির যখন তা গত হতে থাকে।

⁃ সূরা ফজর : ১-৪

এ চার আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তাআলা পাঁচটি জিনিসের কসম খেয়েছেন।

১. ফজরের।

২. দশ রাত্রির।

৩. জোড়ের।

৪. বেজোড়ের।

৫. এবং রাতের।

অধিকাংশ তাফসিরবিদ যেমন- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., কাতাদা, মুজাহিদ, সুদ্দি, যাহ্হাক, কালবি রহ. প্রমুখ ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা জিলহজের প্রথম দশরাত উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫-৫৩৬

এর সত্যায়ন একটি মারফু হাদিস দিয়েও হয়। যা হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত,

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাজরের তাফসিরে বলেন-

عن أبي الزبير عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : { والفجر وليال عشر } قال : العشر عشر الأضحى و الوتر يوم عرفة و الشفع يوم النحر-

-‘ফজর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সকাল। আর দশরাত্রি দ্বারা জিলহজের প্রথম দশ রাত উদ্দেশ্য। যাতে কুরবানিও শামিল রয়েছে। এবং الوتر দ্বারা আরাফার দিন নবম জিলহজ উদ্দেশ্য। আর الشفع দ্বারা দশম জিলহজ বুঝানো হয়েছে। – শুআবুল ইমান-৩/২৫২; ফাজায়িলুল আওকাত-৩৪০; মুস্তাদরাকে হাকিম-৪/২২০

وفي “تفسير ابن كثير”: روى أحمد عن جابر مرفوعا: أن هذا هو العشر الذي أقسم الله به في قوله: { وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ } [ الفجر: 1 ، 2 ].

• আল্লহ তাআলা বলেন—

وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ

উহার উপর নিদির্ষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করিতে পারে। ⁃ সূরা হাজ্জ-২৮।

وفي الْبُخَارِيّ: قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: {وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ} [الحج: 28] الأيام المعلومات: أَيَّامُ العَشْرِ.

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন— উক্ত আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলি হল, যিলহজ মাসের দশ দিন। ⁃ সহীহ বুখারী।

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন,

আল্লাহকে স্মরণ ও তার নাম উচ্চারণ শুধু যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট নয়; বরং সুনির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণ অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের যেসব নেয়ামত দান করেছেন, বিশেষত জীব-জন্তুকে তাদের অধীন করে দিয়েছেন, তাদের খাদ্য বানিয়েছেন, ইত্যাদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৮৯; লাতায়িফুল মাআরিফ ৩৬১।

• অধিক ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ: مَا مِنْ أَيَّامٍ العَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ العَشْرِ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلاَ الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ : وَلاَ الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ. رواه الترمذي وقال: حَسَنٌ صَحِيحٌ. ورواه البخاري مختصرا.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের ইরশাদ বর্ণনা করেছেন-

এমন কোনো দিন নেই, যার আমল যিলহজ্জ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।

আরজ করা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি নয়?

বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে এবং কোনো কিছু নিয়েই ফিরে আসে নি, (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে) তার কথা ভিন্ন।- বুখারী : ৯৬৯, আবূ দাউদ : ২৪৪০, তিরমিযী : ৭৫৭

• আশরায়ে যিলহজ্ব’ বা দশ দিনের ফযীলতপূর্ণ আমলগুলো :

• ক) হজ্জ করা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا، ومن كفر فان الله غنى عن العلمين.

মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। ⁃ সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন-

يا أيها الناس! إن الله كتب عليكم الحج، فحجوا، فقال رجل : أكل عام يا رسول الله؟ فكست حتى قالها ثلاثا، ثم قال : لو قلت نعم لوجبت ولما استطعتم.

হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্ব করো। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হজ্ব করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হজ্ব করা) ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৩৭ (৪১২); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১০৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১০; শরহে মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১৪৭২; সুনানে দারাকুতনী ২/২৮১

ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে,

হজ্ব (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য। ⁃ মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩০৪; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ৩২০৯

হজ্ব করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ্ব করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে।

‘আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

যে ব্যক্তি ‘বায়তুল্লাহ’ পৌঁছার পথের খরচের মালিক হয়েছে অথচ হজ্জ/হজ পালন করেনি সে ইয়াহূদী বা খ্রীস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক এতে কিছু যায় আসে না। আর এটা এ কারণে যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘মানুষের জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ/হজ পালন করা ফরয, যে ব্যক্তি ওখানে পৌঁছার সামর্থ্য লাভ করেছে।’’ ⁃ সুনানে তিরমিযী; তিনি বলেছেন, এটি গরীব। এর সনদে কালাম আছে। এর এক রাবী হিলাল ইবনু ‘আব্দুল্লাহ মাজহূল বা অপরিচিত এবং অপর রাবী হারিস য‘ঈফ বা দুর্বল।

قال النبى صلى الله عليه وسلم من لم يمنعه من الحج حاجة ظاهرة اوسلطان جائر او مرض حابس فمات ولم يحج فليمت إن شاء يهوديا او نصرانيا.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কোনো ব্যক্তির জন্য বাহ্যিক প্রয়োজন, অত্যাচারী বাদশাহ কিংবা মারাত্মক অসুস্থতা যদি হজ্বে যাওয়ার প্রতিবন্ধক না হয়, আর সে হজ্ব না করেই মারা যায়, তাহলে সে যেন ইহুদী কিংবা খৃষ্টান হয়ে মরে (এতে আমার কোনো পরওয়া নেই)। ⁃ সুনানে দারেমী হা.নং ১৭৮৬।

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন-

من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا.

যে ব্যক্তি হজ্ব করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্ব করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। ⁃ তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮

তিনি আরো বলেন,

আমার ইচ্ছে হয় কিছু লোককে বিভিন্ন শহরাঞ্চল ও লোকালয়ে পাঠিয়ে দিই, তারা সেখানে দেখবে, কারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব করছে না। তারা তাদের উপর কর আরোপ করবে। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়।-প্রাগুক্ত

যারা হজ্ব-উমরা না করে সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টা করে ইসলাম তা কখনো অনুমোদন করে না।

ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لا صرورة في الإسلام.ইসলামে বৈরাগ্য নেই।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজ্বের ক্ষেত্রে কোনো বৈরাগ্য নেই।- মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৩১১৩, ৩১১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৮৬; তবারানী, হাদীস : ১১৫৯৫; শরহু মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১২৮২

ইকরামা রাহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল, সারুরা কী? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হজ্ব-উমরাহ কিছুই করে না ; অথবা যে ব্যক্তি কুরবানী করে না। ⁃ শরহু মুশকিলুল আছার ২/২১৫-১৬

• খ) কুরবানী করা।

আল্লাহ তায়ালা বলেন—

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ

তোমার রবের উদ্দেশ্যেই (ঈদের) সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো ।- সূরা কাউসার, আয়াতঃ ২।

যার সারমর্ম এই যে, ‘সালাত আদায় করুন’ শব্দে ঈদের নামায এবং ‘কুরবানী করুন’ শব্দে ঈদুল আযহার কুরবানীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আয়াতটি তে আদেশ এসেছে, যা ওয়াজিবের অর্থ প্রমাণ করে। অতএব কুরবানী করা ওয়াজীব!

ইমাম শাওকানী রহঃ এবং হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. আয়াতটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন:—

ﻗﺎﻝ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ، ﻭﻋﻄﺎﺀ، ﻭﻣﺠﺎﻫﺪ، ﻭﻋﻜﺮﻣﺔ، ﻭﺍﻟﺤﺴﻦ : ﻳﻌﻨﻲ ﺑﺬﻟﻚ ﻧﺤﺮ ﺍﻟﺒُﺪْﻥ ﻭﻧﺤﻮﻫﺎ . ﻭﻛﺬﺍ ﻗﺎﻝ ﻗﺘﺎﺩﺓ، ﻭﻣﺤﻤﺪ ﺑﻦ ﻛﻌﺐ ﺍﻟﻘﺮﻇﻲ، ﻭﺍﻟﻀﺤﺎﻙ، ﻭﺍﻟﺮﺑﻴﻊ، ﻭﻋﻄﺎﺀ ﺍﻟﺨﺮﺍﺳﺎﻧﻲ، ﻭﺍﻟﺤﻜﻢ، ﻭﺇﺳﻤﺎﻋﻴﻞ ﺑﻦ ﺃﺑﻲ ﺧﺎﻟﺪ، ﻭﻏﻴﺮ ﻭﺍﺣﺪ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻠﻒ

ইবনে আব্বাস রা. আতা, মুজাহিদ, ইকরিমা, ও হাসান (বসরী) বলেছেন, আয়াতের মর্ম হলো, উট বা অন্য পশু কুরবানী করা। একই কথা বলেছেন কাতাদা মুহাম্মদ ইবনে কাব আল-কুরাজী, দাহহাক, আর রাবী’, আতা আল-খুরাসানী, হাকাম, ইসমাঈল ইবনে আবু খালিদ ও অনেক পূর্বসূরি। (দ্র: সূরা কাউসার এর তাফসীর)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

من كان له سعة ولم يضح فلا يقربن مصلانا

যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা তথা ওয়াজিব হওয়া সত্বেও কুরবানী করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। ⁃ সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬, সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ৪৭৪৩। হাদীসটি ‘মারফ‚’ ও ‘মাউকূফ’ উভয়ভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদীসবিষারদ যফর আহমাদ উসমানী রাহ.-সহ বহু মুহাদ্দিস উভয় বর্ণনাকেই ‘সহীহ’ বলেছেন। আর হাদীসের শব্দ ও মর্ম দেখেও তা ‘মারফ‚’ বলেই মত প্রকাশ করেছেন। (দ্র. ইলাউস সুনান, খ. ১৭, পৃ. ২১২-২২৫)]

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর এরূপ ধমকে প্রমাণিত হয় যে, যদি কুরবানি করা সাধারণ সুন্নত হতো, তাহলে তিঁনি এতো কঠোর ভাষা ব্যবহার করতেন না। এমনকি রাসুল সাঃ বা সাহাবীরা জীবনেও কুরবানি করা পরিত্যাগ করেন নি। বরং কুরবানী করতে আদেশ দিয়েছেন… আর রাসুলুল্লাহর সঃ আদেশ মানা ওয়াজিব।

আর হাদীসের ভাষায় কোন কিছু না করার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ধমকি ও সতর্কবাণী সে ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়- যদি আমলটি আবশ্যকীয় হয়।

দ্বিতীয়ত:

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় কুরবানী শুরু করার পর একবারও বাদ দেননি।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছরের প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন।- জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫

ফিকহের পরিভাষায় নবীজীর এমন নিয়মিত করা আমল সম্পর্কে বলা হয়-

مواظبة النبي صلى الله عليه وسلم

(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত আমল) এই নিয়মিত আমল- এটাও আমলটি ওয়াজিব হওয়ার বা আবশ্যকীয় হওয়ার আলামত।

অপর হাদীছে এসেছে—

أَخْبَرَنَا عَمْرُو بْنُ زُرَارَةَ قَالَ: حَدَّثَنَا مُعَاذٌ وَهُوَ ابْنُ مُعَاذٍ قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ عَوْنٍ قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو رَمْلَةَ قَالَ: أَنْبَأَنَا مِخْنَفُ بْنُ سُلَيْمٍ قَالَ: بَيْنَا نَحْنُ وُقُوفٌ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَرَفَةَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ عَلَى أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أَضْحَاةً، وَعَتِيرَةً» قَالَ مُعَاذٌ: «كَانَ ابْنُ عَوْنٍ يَعْتِرُ أَبْصَرَتْهُ عَيْنِي فِي رَجَبٍ»

মিখনাফ ইব্ন সুলায়ম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেনঃ আমরা আরাফায় রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে অবস্থানরত ছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! প্রতি বছর প্রত্যেক পরিবারে একটি কুরবানী করা ওয়াজিব এবং একটি ‘আতীরা।৩ মু’আয (রাঃ) বলেনঃ ইবন আউন রজবে ‘আতীরা করতেন, আমি স্বচক্ষে তা দেখেছি। ⁃ সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪২২৪, হাদিসের মান: হাসান সহিহ।

এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন-

أَوَاجِبَةٌ هِيَ؟ فَقَالَ: ضَحّى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالمُسْلِمُونَ، فَأَعَادَهَا عَلَيْهِ، فَقَالَ: أَتَعْقِلُ؟ ضَحّى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالمُسْلِمُونَ.

কুরবানী কি আবশ্যকীয় আমল?

তিনি উত্তর দিলেন-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করেছেন।

লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলে তিনি এবার বললেন,

তুমি কি কিছু অনুধাবন করতে পারছ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করেছেন। ⁃ জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৬

এখানে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। (ওয়াজিব বা সুন্নত- নাম যাই হোক) কুরবানী মুসলমানদের মাঝে সুন্নতে মুতাওয়ারাছা (নিয়মিত হয়ে আসা আমল)

এটা দ্বীনের একটি শিআর।

সেজন্যই এই আমলের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন অবান্তর যে, এটি ওয়াজিব, নাকি ওয়াজিব নয়- তোমার করণীয় তুমি পালন কর। আমরাও সেকথাই বলি।

ওয়াজিব-সুন্নত নাম যা-ই দেন, কুরবানী থেকে পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ফুকাহায়ে কেরাম পরিভাষা কী ব্যবহার করেছেন, তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল মুসলমানদের আমল এবং আমলের توارث বা পরম্পরা দেখা। মাযহাবী পরিভাষার বিতর্কে না গিয়ে আমরা কুরবানীর ক্ষেত্রে সব যুগে মুসলমানদের আমল দেখলে বুঝতে পারব যে, কুরবানী আবশ্যকীয় একটি আমল এবং ইসলামী শরীয়তের একটি শিআর।

বিখ্যাত ফিকহী বিশ্বকোষ আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ এর ভাষ্য হলো: –

وَذَهَبَ أَبُو حَنِيفَةَ إِلَى أَنَّهَا وَاجِبَةٌ . وَهَذَا الْمَذْهَبُ هُوَ الْمَرْوِيُّ عَنْ مُحَمَّدٍ وَزُفَرَ وَإِحْدَى الرِّوَايَتَيْنِ عَنْ أَبِي يُوسُفَ . وَبِهِ قَال رَبِيعَةُ وَاللَّيْثُ بْنُ سَعْدٍ وَالأَْوْزَاعِيُّ وَالثَّوْرِيُّ وَمَالِكٌ فِي أَحَدِ قَوْلَيْهِ

আবু হানিফা রাহ. এর মতে কুরবানী ওয়াজিব। আরো যে সব ফকিহী উক্ত মত পোষন করেছেন তারা হলেন, ইমাম মুহাম্মাদ, আবু ইউসুফ ((এক মতানুযায়ী), যুফার রহ.। অন্যান্যদের মধ্যে এই মত পোষন করেছেন, রবি, লাইস ইবনে সাদ, আওযায়ী, ছাওরী এবং ইমাম মালেক রহ. (এক মতানুযায়ী)। ⁃ আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ৫/৭৭।)

কুরবানী ওয়াজিব এই বিষয়ে ইমাম ও আলেমগণের আরো মতামত এবং তাদের দলীল বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ

আল-ফিকহুল ইসলামিয়্যু ও আদিল্লাতুহু, ৪/২৪৫-৪৬; আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ৫/৭৬-৭৭, আল-ফিকহ আলা মাজাহিবির আরবা, ১/১১০৭।

• কুরবানীর ফযীলত—

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ ، قَالَ : قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ ؟ قَالَ : ” سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ “. قَالُوا : فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : ” بِكُلِّ شَعَرَةٍ حَسَنَةٌ “. قَالُوا : فَالصُّوفُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : ” بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ حَسَنَةٌ “. رواه إبن ماجه. حكم الحديث: ضعيف

হযরত যায়েদ বিন আরকাম রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবা রা. গণ বললেন,

হে আল্লাহর রাসূল! এ সকল কুরবানীর ফযীলত কি?

উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন-

তোমাদের জাতির পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নাত।

তারা (রা.) পুনরায় আবার বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?

উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন-

কুরবানীর পশুর প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে।

তারা (রা.) আবারো প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ভেড়ার লোমের কি হুকুম? (এটাতো গণনা করা সম্ভব নয়),

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন-

ভেড়ার লোমের প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। ⁃ সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬, সনদ যয়ীফ।

• গ) বেশি পরিমাণে তাকবীর-তাহলীল-তাসবীহ পাঠ করা —

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

وعن ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: “مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ فِيهِنَّ الْعَمَلُ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ: عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ- أَوْ قَالَ: الْعَشْرُ- فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّسْبِيحِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ”. رَوَاهُ ابْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَعَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ وَأَبُو يَعْلَى، وَالْبَيْهَقِيُّ فِي الشُّعَبِ بِسَنَدٍ صَحِيحٍ. إتحاف الخيرة المهرة للبوصيري 3/170.

এ দশ দিন নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই।

তাই তোমরা এ সময়ে —

তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।- মুসনাদ আহমাদ : ১৩২, বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৩৪৭৪

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَأَبُو هُرَيْرَةَ: «يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ العَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا» رواه البخاري.

হযরত ইবনে উমর রাযি. ও হযরত আবূ হুরায়রাহ রাযি এ দশ দিনে বাজারে বের হতেন তখন তাকবীর বলতেন, তাদের তাকবীরের সাথে মানুষরাও তাকবীর বলত।- সহীহ বুখারী।

• ঘ) আইয়ামে তাশরীকে তাকবীর বলা

নয় যিলহজের ফজর থেকে তের তারিখের আছর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামায হয়।

এই ২৩ ওয়াক্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর একবার এই তাকবীর পড়বে—

اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لَاإِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الحَمْدُ

আলী রা. থেকে বর্ণিত নিচের হাদিসটিতে তাকবীর পড়ার কথা বলা হয়েছে—

عن علي رضي الله عنه : أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة، إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق، ويكبر بعد العصر. رواه ابن أبي شيبة في مصنفه –

হযরত আলী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি আরাফার দিন তথা নয় যিলহজ্জ ফজরের পর হতে আইয়ামে তাশরীকের শেষদিনের আছরের পর তাকবীর দিতেন।⁃ মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ।

এ ছাড়া ফাতাওয়ার কিতাবের ইবারতও দেখা যেতে পারে-

فَعِنْدَ أَبِي حَنِيفَةَ آخِرُهُ عَقِيبَ صَلَاةِ الْعَصْرِ مِنْ يَوْمِ النَّحْرِ وَعِنْدَهُمَا عَقِيبَ صَلَاةِ الْعَصْرِ مِنْ آخِرِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ فَعِنْدَهُ يُكَبِّرُ عَقِيبَ ثَمَانِي صَلَوَاتٍ وَعِنْدَهُمَا عَقِيبَ ثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ صَلَاةً … وَالْفَتْوَى عَلَى قَوْلِهِمَا كَذَا فِي الْمُصَفَّى

-আল-জাওহারাতুন নাইয়িরাহ : খ. ১, পৃ. ৩৭৭

আরো দেখুন—

ফাতওয়া শামী-তৃতীয় খন্ড, ৬১ পৃষ্ঠা, সালাত অধ্যায়, ঈদ পরিচ্ছেদ,

ইলাউস সুনান, সালাত অধ্যায়, তাকবীরাতুত তাশরীক পরিচ্ছেদ, ৮ম খন্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা।

বুখারীতে এসেছে :—

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَأَبُو هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا: يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ العَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا. صحيح البخاري ،كتاب العيدين : باب فضل العمل في أيام التشريق.

সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন।- সহীহ বুখারী।

অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

এই তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা উচিত।

তবে নারীরা নিচু-স্বরে পাঠ করবে।

আজকে আমাদের সমাজে এ সুন্নতটি পরিত্যাজ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এর আমল দেখা যায় না।

তাই আমাদের উচিত হবে এ সুন্নতটির প্রচলন করা। এতে তাকবীর বলার সওয়াব অর্জন হবে ও সাথে সাথে একটি মিটে যাওয়া সুন্নত জীবিত করার সওয়াব পাওয়া যাবে।

হাদীসে এসেছে :—

قَالَ رَسَوْلُ اللهِ- صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ أَحْيَا سُنَّةً مِنْ سُنَّتِي أُمِيتَتْ بَعْدِي كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، رواه الترمذي 677 وابن ماجه 209

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘আমার ইন্তেকালের পরে যে সুন্নতটির মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এ সুন্নত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবে কোন অংশ কম হবে না।’ ⁃ তিরমিযী-৬৭৭, ইবনে মাজাহ-২০৯।

• ঙ) দিনে রোযা রাখা , রাতে ইবাদত করা; ১-৯ দিন

আশরায়ে যিলহজ্বের বিশেষ আরেকটি আমল হল, ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত প্রথম নয় দিন রোযা রাখা।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে;

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।- সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭, হাদীস : ২৫৯২০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৪১৬; মাআরিফুস সুনান ৫/৪১-৪৪

অন্য হাদীসে হযরত হাফসা রা. বর্ণনা করেন-

أربع لم يكن يدعهن النبي صلى الله عليه وسلم : صيام عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر وركعتين قبل الغداة.

চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস :২৪১৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৭০৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৬৩৩৯

অন্য দুটি বর্ণনায় এসেছে যে,

এই দিনগুলোর একেকটি রোযায় রয়েছে এক বছরের রোযার সমান ছওয়াব।- জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; বায়হাকী-শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬ হাদীস : ৩৭৫৮; তারগীব হাদীস : ১৭৩১; আত তা’রীফ ৫/৫১৫-৫১৭ হাদীস : ৮৩৫, সনদ যয়ীফ।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: وَإِنَّ صِيَامَ يَوْمٍ فِيهَا لَيَعْدِلُ صِيَامَ سَنَةٍ، وَلَيْلَةٍ فِيهَا بِلَيْلَةِ الْقَدْرِ” . رواه ابن ماجة بإسناد ضعيف لضعف مسعود بن واصل وشيخه النهاس بن قهم. الْقَدْرِ-

-….. এ সময়ে একদিন রোযা রাখা অন্য সময়ের একবছর রোযা রাখার সমান। একরাতের ইবাদত শবে কদরের মতো মহান। – বায়হাকি শুআবুল ইমান- ৩/৩৫৫, ফাজায়িলুল আওকাত-৩৪৬, সনদ যয়ীফ।

وَكَانَ سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ إِذَا دَخَلَ أَيَّامُ الْعَشْرِ اجْتَهَدَ اجْتِهَاداً شَدِيداً، حَتَّى مَا يَكَادُ يَقْدِرُ عَلَيْهِ. رواه الدارمي بسند صحيح.

হযরত সাঈদ বিন জুবায়ির রহ. এ দশ দিনে প্রচন্ড কঠোর পরিশ্রম করতেন, যতক্ষণ শক্তি থাকত।⁃ সুনানে দারিমী, সনদ সহীহ।

• ৭০০ গুণ বেশি নেকী—

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ : وَإِنَّ صِيَامَ يَوْمٍ مِنْهَا يَعْدِلُ بِصِيَامِ سَنَةٍ، وَالْعَمَلَ فِيهِنَّ يُضَاعَفُ سَبْعمِائَةِ ضِعْفٍ . رواه الْبَيْهَقِيُّ فِي الشُّعَبِ بِسَنَدٍ لا بأس به، قاله الغماري في “المداوي”.

….. এ সময়ে একদিন রোযা রাখা অন্য সময়ের একবছর রোযা রাখার সমান। এবং এ সময়ের আমলের নেকী ৭০০ গুণ নেকী করা হয়।- শুআবুল ঈমান, বায়হাকী। ইমাম গুমারী বলেন: সনদ লা বা’সা বিহী তথা অগ্রহণযোগ্য নয়।

• এই নয়দিনের রোযার মধ্যে নবম তারিখ বা আরাফার দিনের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ।

অতএব পুরো নয়টি রোযা রাখতে না পারলে এই একটি রোযা থেকে কারো বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়।

• চ) আরাফার দিনের রোযার ফযীলত :

সহীহ হাদীসে হযরত আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত:

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ. رواه مسلم.

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন অর্থাৎ নবম তারিখের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেবেন। ⁃ সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৪৯

আরেক হাদীসে এসেছে-

من صام يوم عرفة غفر له سنتين متتابعتين.

যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের (গুনাহ ক্ষমা করা হবে।-মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৭৫৪৮; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫১৪১

• ইয়াওমে আরাফা’ উদ্দেশ্য— ৯ জিলহজ্ব।

এটিই সঠিক ব্যাখ্যা।

কারণ, এই রোযা আরাফা বা উকুফে আরাফার আমল নয়; তা ঐ তারিখের আমল।‘ইয়াওমে আরাফা’হচ্ছে ঐ তারিখের (নয় যিলহজ্বের) পারিভাষিক নাম।

উদ্দেশ্য, নয় তারিখে বা ঈদের আগের দিন আমলটি করতে হবে।

তবে মনে রাখা উচিত,

অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে হাজীদের জন্য এই দিনে আরাফার ময়দানে ওকূফ ও মুজাহাদার শক্তি অর্জনের নিমিত্তে রোযা না রাখা উত্তম।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্বের মধ্যে এই দিনের রোযা রাখতেন না।- সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২৩, ১১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫০-৭৫১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪১৯; মাআরিফুস সুনান ৫/৪৩০-৪৩১

• ছ) আরাফার দিনের দুআ—

أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ. رواه الترمذي، حسن

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শ্রেষ্ঠ দুআ হল আরাফা দিবসের দুআ।- সুনানে তিরমিযী, সনদ হাসান।

قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمْ الْمَلَائِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ. )رواه مسلم (1348

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেন: ‘আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায়? (মুসলিম: ১৩৪৮)

• ঈদের দিন সমূহের একটি দিন—

হাদীসে এসেছে :

رَوَى أَبُوْ دَاوُدَ عَنْ أَبِيْ أٌمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ يَوْمَ عَرَفَةَ ، وَيَوْمَ النَّحْرِ ، وَأَيَّامَ التَّشْرِيقِ ، عِيدُنَا أَهْلَ الإِسْلامِ ، وَهِيَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ . صححه الألباني في صحيح أبي داود برقم 2114

সাহাবি আবু উমামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কুরবানির দিন, ও আইয়ামে তাশরীক (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন।-আবু দাউদ: ২১১৪।

হাজীদের জন্য আরাফার দিন ঈদ আর যারা হজ্জ করতে যাননি, তাদের জন্য রোযার বিধান রয়েছে।

• জ. নখ-চুল না কাটা—

যিলহজের চাঁদ দেখা হতে কুরবানী করা পর্যন্ত শরীরের অবাঞ্চিত পশম, চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকা। বরং কুরবানীর পর কাটা। — এটা মুস্তহাব।

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ: «إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ». رواه مسلم

হযরত উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যদি যিলহজ্বের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে থাকে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।- সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৩২; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৯

وعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ: «أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ». قَالَ الرَّجُلُ: أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا أُضْحِيَّةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: «لَا، وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ، فَتِلْكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ».

আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।- মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭৭৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৪৩৬৫

ওলীদ ইবনে মুসলিম রহ. বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলান রহ.কে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রহ. বলেছেন-

إن ابن عمر مر بامرأة تأخذ من شعر ابنها في الأيام العشر فقال : لو أخرتيه إلى يوم النحر كان أحسن.

অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস: ৭৫৯৫

সুলাইমান আততাইমী রহ. বর্ণনা করেন-

كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره أن يحلق الصبيان في العشر.

‘ইবনে সীরীন রহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দশকে তিনি ছোট বাচ্চাদের মাথা মুন্ডানোকেও অপছন্দ করতেন।’ -আল মুহাল্লা, ইবনে হাযম ৬/২৮

এসব দলীলের ভিত্তিতে কারো কারো মতে, যারা কুরবানী করবে না তাদের জন্যও যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ, মোচ, চুল ও অবাঞ্ছিত লোম না-কাটা উত্তম।

*যারা কোরবানি করবেন না, উক্ত হাদিস অনুযায়ী তারাও এই আমল করলে সওয়াব পাবেন, ইনশাআল্লাহ।

উল্লেখ্য, এই হুকুম শুধু তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা যিলকদ মাসের শেষদিকে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে। যা সুন্নাতের খেলাফ। আর যদি এই দশকে নখ-চুল ও অবাঞ্ছিত পশম কাটা থেকে বিরত থাকলে এসবকিছু না কাটার মেয়াদ ৪০ দিন ছাড়িয়ে যায় তবে উল্লেখিত আমল করা যাবে না।- হাশিয়াতুত তহতাবী আলালমারাকী ২৮৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৬।

সহীহ হাদীসে আছে,

হযরত আনাস রা. বলেন, গোঁফ কর্তন করা, নখ কাটা, বগল ও নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করার বিষয়ে আমাদের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন তা ৪০ দিনের বেশি বিলম্ব না করি।- সহীহ মুসলিম ১/১২৯।

আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত একটি ইবাদত মুসলমানের উপর ফরয করেছেন। সামর্থ্যবান ‘আশিকে রব’ এই দিনে ইহরামের শুভ্র লেবাস পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হয় তখন তার উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন্তু’ বাইতুল্লাহর যিয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনি, পারেনি কাবার কালো গিলাফের ছায়ার কাছে যেতে, পৃথিবীর দূর-দূরানে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ‘অভাগা’ মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যে, তোমরা ‘ভাগ্যবান’ হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর। তোমরাও নখ-চুল কেটো না। আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও স্নাত করে তুলতে পারে। ⁃ ইসলাহী খুতবাত ২/১২৪-১২৫

• ঈদের দিন পালন—

হাদীসে এসেছে :

عَنِ الْحَسَنِ بن عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم أَنْ نَلْبَسَ أَجْوَدَ مَا نَجِدُ وَأَنْ نَتَطَيَّبَ بِأَجْوَدِ مَا نَجِدُ وَأَنْ نُضَحِّيَ بِأَسْمَنِ مَا نَجِدُ الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُورُ عَنْ عَشَرَةٍ وَأَنْ نُظْهِرَ التَّكْبِيرَ وَعَلَيْنَا السَّكِينَةُ وَالْوَقَارُ

হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (কুরবানীর দিনে) আমরা যেন যথাসাধ্য সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরি, যথাসাধ্য সবচেয়ে ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করি, যথাসাধ্য সবচেয়ে মোটা-তাজা কুরবানী দিই—গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উট দশজনের পক্ষ থেকে। আর আমরা যেন ‘তকবীর’সশব্দে বলি এবং প্রশান্তি ও ভদ্রতা বজায় রাখি।’ ⁃ তবরানী, মুজামুল কাবীর ৩/১৫২, ২৬৯০, হাকেম ৪/২৫৬, ৭৫৬০, ত্বাহাবী ১৪/৩৩, শুআবুল ঈমান বাইহাক্বী ৩/৩৪২।

رَوَى أَبُوْ دَاوُدَ عَنْ أَبِيْ أٌمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ يَوْمَ عَرَفَةَ ، وَيَوْمَ النَّحْرِ ، وَأَيَّامَ التَّشْرِيقِ ، عِيدُنَا أَهْلَ الإِسْلامِ ، وَهِيَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ . صححه الألباني في صحيح أبي داود برقم 2114

সাহাবি আবু উমামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কুরবানির দিন, ও আইয়ামে তাশরীক (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন।-আবু দাউদ: ২১১৪।

রাসুলুল্লাহ সঃ কুরবানীর সময়ে বলতেনঃ

«بِسْمِ اللّهِ وَاللّهُ أَكْبَرُ اللّهُمَّ هذَا عَنِّي وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِىْ»

অর্থাৎ হে আল্লাহ এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবূল করো। কবুল করো আমার উম্মাতের মধ্য থেকে যারা কুরবানী করতে অক্ষম/অসমর্থ্য, তাদের পক্ষ হতে। ⁃ আবূ দাঊদ ২৮১০, আত্ তিরমিযী ১৫২১, আহমাদ ১৪৮৯৫, মিশকাত ১৪৫৪ ।

• সারকথা—

এ হাদীসগুলোতে যিলহজ্বের দশ দিনের আমল-ইবাদতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।

* জিলহজের রাতে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নেই। নিজের অবস্থা, চাহিদা ও রুচি মোতাবেক যে-কোনো ইবাদত করতে পারেন।

* তেলাওয়াত, জিকির, নামায, দান-খয়রাত, ইলমচর্চা যে-কোনো ইবাদত করা যায়। কোনো ইবাদতকে নির্দিষ্ট করা ঠিক নয়।

জিলহজের প্রথম দশকে করণীয় হলো-

* রাতজেগে ইবাদত করা।

* প্রথম নয়দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব।

* বিশেষত আরাফার দিন অর্থাৎ জিলহজের নয় তারিখে রোযা রাখা।

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ অঞ্চলের নয় তারিখ অনুপাতে রোযা রাখবে। সৌদি আরবের নয় তারিখে নয়।

* যারা কুরবানী করবেন তাদের জন্য যিলহজ্জের চাঁদ দেখার পর কুরবানী করার আগ পর্যন্ত নখ, চুল ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তহাব।

*যারা কোরবানি করবেন না, উক্ত হাদিস অনুযায়ী তারাও এই আমল করলে সওয়াব পাবেন ইনশাআল্লাহ।

জিলহজ মাস একেবারে আমাদের দোরগোড়ায়।

হজ-কুরবানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর পাশাপাশি নফল সিয়াম ও বিবিধ আমল করে অশেষ সওয়াব হাসিল করা যায় এই মাসে।

আল্লাহপাক আমাদেরকে বরকতের এসময়গুলোতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করার তাওফিক দান করুন। আমীন

– মুফতী মাসুম বিল্লাহ।

Facebook Comments Box